অভিজ্ঞতা নেই, তবু কাজ পেলেন বিএনপির নেতা-কর্মীরাই

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন

সৌন্দর্যবর্ধন কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না চট্টগ্রাম নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. ইফতেখার উদ্দীনের। এরপরও তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ পেতে যাচ্ছেন। এ রকম বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অন্তত ৩২ জন পাচ্ছেন কাজ, যাঁদের আগে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শুধু দলীয় পরিচয়ে এই কাজ পাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

চট্টগ্রামের বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের দায়িত্বশীল নেতা ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে বরাদ্দ পেতে যাওয়া ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে জানা গেছে।

সিটি করপোরেশন ১১টি ওয়ার্ডে ৪০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজের জন্য চূড়ান্ত করেছে। সবাই সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, সৌন্দর্যবর্ধনের প্রস্তাব নিয়ে সিটি করপোরেশনে সাক্ষাতের সময় অভিজ্ঞ ও ভিন্ন মতের ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে কাজ পাওয়া নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা মো. ইফতেখার উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, আগে কখনো সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়নি। তবে কাগজপত্র ঠিক থাকায় কাজ পেয়েছেন।

আগের মেয়ররা যা করতেন, বর্তমান মেয়রও তা-ই করছেন। অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের লোকদের কাজ দিয়েছেন। মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কাজ আর টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে।
আখতার কবির চৌধুরী, সম্পাদক, সুজন, চট্টগ্রাম

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টিতে কোনো প্রস্তাব জমা পড়েনি। বাকি ৩১টিতে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ২৫৭টি প্রস্তাব জমা পড়ে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নগরের ১১টি ওয়ার্ডে ৪০টি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত করেছে সিটি করপোরেশন। মেয়র শাহাদাত হোসেন কানাডা থেকে আসার পর বাকি ১৮টি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।

আদালতের রায়ে মেয়র নির্বাচিত হয়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব নেন নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শাহাদাত হোসেন। তিনি আগের মেয়র ও প্রশাসকের আমলে হওয়া সব সৌন্দর্যবর্ধন চুক্তি বাতিল করেন। এরপর গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য প্রস্তাব আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন হয়নি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ নিয়ে দলীয়করণ এবারই প্রথম নয়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ও তৎকালীন মেয়রদের ঘনিষ্ঠ এবং ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতারা এসব কাজ পেতেন।

সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা জানান, সৌন্দর্যবর্ধনের আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের অর্থায়নে যাত্রীছাউনি, সড়কে আলোকায়ন, খোলা জায়গায় বাগান, সড়কদ্বীপে সবুজায়ন, স্মারক ইত্যাদি করতে পারবে। এর বিনিময়ে কোথাও দোকান নির্মাণ, কোথাও বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ রয়েছে। এলাকা ও প্রকল্প ভেদে মাসে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করার সুযোগ রয়েছে। তবে এ জন্য সিটি করপোরেশনকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দিতে হবে।

প্রাধান্য পেয়েছে দলীয় পরিচয়

নগরের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩টি আবেদন জমা পড়েছিল শুলকবহর ওয়ার্ডে। কাজ পেয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহেদ হোসেন খান, যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম, যুবদলের খুলশী থানার সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রমজান আলী, নগর বিএনপির সাবেক সদস্য মো. জাকির হোসেন, শুলকবহর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক সাদেক আহমেদ ও নগর যুবদলের সদস্য গোলাম ইয়াজদানী। এ ছাড়া কাজ পাওয়া বাকি আটজন বিএনপির কর্মী-সমর্থক।

বিএনপি নেতা মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থপতি দিয়ে নকশা করে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। সিটি করপোরেশন যাচাই-বাছাই করে সে নকশাকে যোগ্য মনে করেছে বলে কাজ দিয়েছে।’

নগরের জালালাবাদ ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহসভাপতি মুজিবুর রহমান, ছাত্রদলের কর্মী মো. গিয়াস উদ্দিন, বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সালামত আলীম মো. জাকির হোসেন ও মো. সাখাওয়াত হোসেন।

মোহরা ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন যুবদলের কর্মী মো. রাশেদ আলম। পূর্ব ষোলোশহর ওয়ার্ডে যুবদলের রাজনীতিতে যুক্ত মো. আয়ুব আহমেদ ও আবদুর রব এবং পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন বিএনপির মো. হাসান মনসুর।

উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন নগর যুবদলের সাবেক সহসভাপতি দিদারুল ফেরদৌস ও যুবদল নেতা মো. নূর হোসেন; উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডে নগর যুবদলের সাবেক প্রচার সম্পাদক মো. মোশাররফ হোসেন এবং সাবেক যুবদল নেতা খুরশিদ আলম।

স্থপতি দিয়ে নকশা করে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। সিটি করপোরেশন যাচাই-বাছাই করে সে নকশাকে যোগ্য মনে করেছে বলে কাজ দিয়েছে।
বিএনপি নেতা মো. জাকির হোসেন

দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে কাজ পেয়েছেন মিজানুর রহমান, সরাইপাড়া ওয়ার্ডে যুবদল নেতা দিদারুল ফেরদৌস, লালখান বাজারে বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শাহ আলম এবং পাহাড়তলী ওয়ার্ডে নগর বিএনপির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম।

সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেন ব্যক্তিগত সফরে বর্তমানে কানাডায় অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও মন্তব্য করেননি। তবে গত জানুয়ারিতে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ বণ্টনের বিষয়ে সিটি মেয়র প্রথম আলোকে বলেছিলেন, দলীয় পরিচয় নয়, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগের মেয়ররা যা করতেন, বর্তমান মেয়রও তা-ই করছেন। অনিয়ম, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের লোকদের কাজ দিয়েছেন। মূলত সৌন্দর্যবর্ধনের নামে কাজ আর টাকা ভাগাভাগি হচ্ছে।