স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানো না হলে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে না

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব মো. শামসুল হক, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন

করোনার টিকাদানে বাংলাদেশ সাফল্য দেখিয়েছে। তবে পরিকল্পিতভাবে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে মহামারি মোকাবিলা ও টিকাদানে আরও ভালো করার সুযোগ ছিল। মহামারি স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতি দেখিয়ে দিয়েছে। এখন স্বাস্থ্য খাতের সংস্কারে যে সুযোগ তৈরি করা হয়েছে, তা যেন হাতছাড়া না হয়। এ ব্যাপারে সবাইকে আরও মনোযোগী হওয়া উচিত।

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ‘করোনা টিকাদানে জনসম্পৃক্ততা: সাফল্য, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক এই গোলটেবিল বৈঠক যৌথভাবে আয়োজন করে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশ ও প্রথম আলো। সহযোগিতায় ছিল ইউনিসেফ বাংলাদেশ।

বৈঠকের প্রধান অতিথি পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, টিকা ও অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সরকার ভালো করেছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরেছে। কঠোর লকডাউনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত খুবই সঠিক ছিল। কঠোর লকডাউনে গেলে অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতো। মহামারির সময় মানুষ সক্রিয় ছিল, সরকারের নেতৃত্ব সঠিক ছিল।

পরিস্থিতি কী

করোনা মহামারি শুরুর সময় অথই সমুদ্রে থাকার মতো পরিস্থিতি ছিল, কীভাবে কী করতে হবে, তা কারও জানা ছিল না—এভাবে বক্তব্য শুরু করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনার টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব এবং মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. শামসুল হক। তিনি বলেন, টিকা সংগ্রহের প্রথম বৈশ্বিক আলোচনায় বাংলাদেশ যুক্ত ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও কোভ্যাক্স থেকে পরিকল্পনামাফিক টিকা আনা হয়েছে। বাংলাদেশ ১৭-১৮টি দেশ থেকে এ পর্যন্ত ৩২ কোটি টিকা এনেছে। এর মধ্যে ১৮ কোটি টিকা কিনেছে।

শামসুল হক বলেন, ১৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম ডোজ পেয়েছে ৯৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছে ৯১ শতাংশ মানুষ। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের ৮৬ শতাংশ টিকা পেয়েছে।

২২ জেলায় ৪০টি দলগত আলোচনায় ৫৬০ অংশগ্রহণকারীর মতামত উপস্থাপন করেন দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের কোভিড-১৯ নির্মূল প্রকল্পের পরিচালক সাকিনা সুলতানা।

এতে দেখা গেছে, ৮৫ শতাংশ মানুষ মনে করে, টিকা নিলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে; ৫০ শতাংশ বুস্টার ডোজের সঠিক তথ্য জানে না, ১০ শতাংশ মনে করে করোনার টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ভ্রান্ত ধারণা আছে।

করোনা মহামারি থেকে মানুষ অনেক কিছু শিখেছে উল্লেখ করে অনুষ্ঠানের সভাপতি ও দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার বলেন, মহামারি চলমান আছে। নতুন মহামারির আশঙ্কা আছে। জনগণকে এমনভাবে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে, যেন তারা নিজেরাই মহামারি প্রতিরোধের দায়িত্ব নেয়।

৪ জনস্বাস্থ্যবিদ যা বললেন

গোলটেবিলে উপস্থিত ছিলেন চার জনস্বাস্থ্যবিদ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এটিই শেষ মহামারি নয়। এই মহামারি দেখিয়ে দিয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের ঘাটতি কোথায় কোথায়। স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানো না হলে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে না। মহামারির ক্ষেত্রে আমরা যে সাফল্য দেখছি, তা আপাত সাফল্য।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজীর আহমেদ বলেন, মহামারির মতো পরিস্থিতিতে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করার কিছু পদ্ধতি আছে। এ জন্য জাতীয় কর্মকৌশল প্রণয়নের দরকার ছিল। করা হয়নি। জনগণকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা হয়েছে অ্যাডহক ভিত্তিতে।

জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা, স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের কাজের সমন্বয় এবং কাজের মূল্যায়নের দরকার ছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোমেন রায়হান আন্তমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, দেশে গবেষণা কম হয়েছে। পাশাপাশি মানুষকে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনসহ অনেক বিষয়ে সঠিকভাবে বোঝানো যায়নি।

আরও কিছু করার আছে

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, করোনা মহামারি মোকাবিলা বা টিকা কার্যক্রমে সাফল্য কিছু থাকলে তা এসেছে জনসাধারণের সক্রিয়তায়, সরকারের উদ্যোগে।

করোনা মহামারি নিয়ে বাংলাদেশ, চীন ও পাপুয়া নিউগিনিতে কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইউনিসেফ বাংলাদেশের সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ার চেঞ্জ ম্যানেজার বদরুল হাসান বলেন, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে একটি পরিচ্ছন্ন কর্মপরিকল্পনা তৈরির পাশাপাশি তা বাস্তবায়নে কারিগরি দক্ষতাও প্রয়োজন।

সরকারের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ব্যবস্থাপক মো. শহীদুল আলম বলেন, মাঠপর্যায়ে জনবলের ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন বলেই টিকায় বাংলাদেশ সফল হতে পেরেছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের নবজাতক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক খায়রুল আলম বলেন, তথ্য ও বার্তা এক বিষয় নয়। করোনা মহামারির যথাযথ বার্তা দক্ষতার সঙ্গে মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি।

শেষ পর্যায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা দূর করতে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা অনেক। মসজিদের ইমাম বা খতিব কোনো কথা বললে তা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।

গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম স্বাগত বক্তব্যে বলেন, মহামারি পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে, তবে নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।