অর্থনীতিকে খাদের কিনারে ফেলে জনতার রোষে জন–আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিযুক্ত পূর্ববর্তী সরকার অপসারিত হয়। জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের প্রলম্বিত দুর্বিষহ সংকট থেকে মুক্তির লক্ষ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমজীবী মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি আত্মাহুতি দিয়েছেন। শহীদের তালিকায় তাঁরাই শীর্ষে। অভ্যুত্থানকালে শ্রমজীবীদের পরে শিক্ষার্থীরা শাহাদাতবরণ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ত্যাগ অবিস্মরণীয়। আগ্রাসী সরকারের টিকে থাকার জন্য বর্বরতার নিষ্ঠুরতম দৃষ্টান্ত।
২০০৮ সাল থেকে গড়ে ওঠা কায়েমি রাজনৈতিক গোষ্ঠীতন্ত্রভিত্তিক অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা সর্বজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দিনের পর দিন প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিক অধিকারহীনতা জারি রেখে, আইনের শাসন ও জবাবদিহির প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে, ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের মাধ্যমে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিগত সরকার গণমানুষের ওপর জবরদস্তিমূলক অর্থনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছে। এই নিষ্পেষিত জীবন থেকে মুক্তির আশায় ফ্যাসিবাদবিরোধী জনতা দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়েছেন। গুম-খুনসহ লাখ লাখ মানুষ পৈশাচিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। পুঞ্জীভূত আক্রোশ-আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান।
চলমান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত থেকে উৎসারিত একচেটিয়াবাদী স্বজনতোষী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সর্বজনের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এ কারণে কর্মসংস্থানহীন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে; যুব–বেকারত্ব অসহনীয় পর্যায়ে। নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিনিয়োগ স্থবির। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ে না। প্রকৃত মজুরি কমছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে অধিকাংশ মানুষ বিপর্যস্ত। সমাজে ভাঙন ধরেছে। শ্রমজীবীদের জীবন তলানিতে। লাগামহীন বৈষম্য বেড়েই চলেছে। সম্ভাবনার বাংলাদেশ সর্বজনীন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার পথে বারবার হোঁচট খাওয়ায় জনগণ ন্যায্য অর্থনৈতিক ফলাফল থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
জনগণই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ন্যায়সংগত অর্থনীতি গড়ে তোলার আসল কাজ শুরু করতে পারে।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের অর্থনীতির গতিপথ নির্মাণে জনমানুষের আত্মত্যাগ স্পষ্ট ও জোরালো মৌলিক প্রশ্নের অবতারণা করেছে। নাগরিক–রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ প্যারাডক্স’ বা ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ বা নানা অভিধায় উন্নয়নের মডেলের যে গল্পটা বলা হয়েছে, তার মৌলিক বিষয়ে প্রকট ঘাটতি ছিল। এসব তথাকথিত বয়ান জনমানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ থাকলেই কেবল উন্নয়ন টেকসই হয়।
অর্থনীতির হালহকিকত
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে অর্থনৈতিক খাতের পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। তারা ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। বৈধ পথে প্রবাসী আয়, বিদেশি ঋণের প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং আমদানি খরচ কম হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। ব্যাংকব্যবস্থায় পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন, আইনি কাঠামোয় পরিবর্তনসহ সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই পতিত সরকারের বাজেট পরিবর্তন করা দরকার ছিল। সংসদ না থাকায় সংবিধানের ৯৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাজেট প্রণয়ন ও অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়। অন্যান্য বিষয়ে সরকার যেমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছে, বাজেট বিষয়েও করা উচিত ছিল। বাজেট বিষয়ে বর্তমান সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। সে আলোচনা হলে ঘাটতি পূরণে সংস্কারের রূপরেখাও অর্জিত হতো।
অর্থনীতি বহুমাত্রিক সংকটে জর্জরিত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাবে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। কোভিডের সময় বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি। জিডিপির তুলনায় কর আহরণ মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর আদায় আগের বছরের তুলনায় জিডিপির দশমিক ৬৬ শতাংশীয় পয়েন্ট কমেছে। গত অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে। ৪০৯ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। এক বছরের ব্যবধানে পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ২১ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংক খাতে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি রেকর্ড করেছে। বৈদেশিক জ্বালানিনির্ভরতা ও টাকার মান কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ ব্যয় বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানহীনতা, আয়-ব্যয়বৈষম্য এবং অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রা আজও সংকটাপন্ন। বিশ্বব্যাংকের মতে মূল্যস্ফীতি, চাকরি হারানো ও অর্থনীতিতে ধীরগতির কারণে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়তে পারে। ২০২৫ সালে জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অতিদারিদ্র্যের হার ৯ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা আছে। প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে অতিদারিদ্র্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
বাজারে শ্রমের চাহিদা কমে গেছে। বেসরকারি খাতে নিয়োগ হ্রাস এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে স্থবিরতা কর্মসংস্থানের চিত্রকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, পরিবহন খাতের শ্রমিকেরা আয় হারাচ্ছেন। আরও অসহায় হয়ে পড়ছেন নারী–শ্রমিকেরা, বিশেষত অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মরত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, এক দশকে (২০১৩-২০২২ সাল) গড়ে দেড় শতাংশ হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বেড়েছে; অথচ কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দশমিক ২ শতাংশ। বেকারত্ব বেড়েই চলছে।
রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবণতা থাকলেও মন্দাভাব, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও আয়বৈষম্যজনিত স্থবিরতার আশঙ্কা রয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
ক্রান্তিকাল থেকে রূপান্তর
জোড়াতালি দিয়ে ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা যায় না। কাঠামোগত বৈষম্য দূর করতে হবে। প্রচুর কর্মসংস্থান দরকার। যুবকদের শ্রমবাজারে শোভন মজুরিতে অংশগ্রহণ অত্যাবশ্যক। তা না হলে জনমিতিক লভ্যাংশ (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) অধরাই থেকে যাবে। নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে এবং নয়া শিল্পনীতির ভিত্তিতে বহুমুখীকরণ, প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা তৈরি ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে সস্তা শ্রমের পরিবর্তে মূল্য সংযোজনকে উৎসাহিত করলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দক্ষতা ও উৎপাদনমুখী শিক্ষাকাঠামো ছাড়া নতুন কর্ম নিয়োজন সম্ভব নয়। এমন শিক্ষাকাঠামো, যা যুবকদের শুধু টিকে থাকার জন্য নয়, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে। কাঠামোগত সংস্কারের জন্য মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সার্বিক কৌশল ও পরিকল্পনা জরুরি। রাজনৈতিক ম্যান্ডেট ছাড়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
এটিই মূল কথার অভিমুখ। স্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য স্থিতিশীল রাজনীতি অপরিহার্য। বিনিয়োগকারীরা গোধূলিতে বাজি ধরে না, সূর্যোদয়ের অপেক্ষা করে। এ কারণেই সবচেয়ে জরুরি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। শুধু বৈধ সরকারই প্রকৃত রূপান্তরের জন্য আস্থা, পরিবেশ ও নীতি স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা দিতে পারে।
অর্থনীতির জরুরি মেরামতের চেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ণ। জনগণই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ন্যায়সংগত অর্থনীতি গড়ে তোলার আসল কাজ শুরু করতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়কের অস্থায়ী প্রকল্প হিসেবে নয়, বরং নাগরিকের নির্বাচিত এবং তাদের কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ণ সম্ভব।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়