দিনভর আনন্দ–উচ্ছ্বাসে দেশ গড়ার সংকল্প

শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উল্লাস। ফ্যান্টাসি কিংডম, আশুলিয়া, ঢাকা ৩০ জানুয়ারি
ছবি: সৈয়দ জাকির হোসেন

সূর্য উঠলেও ভালো করে তখনো কুয়াশা কাটেনি। ঘুমের জড়তা ভেঙে কর্মমুখরতা ছড়িয়ে পড়েনি রাজধানীর বুকে। অথচ তখনই মহানগরের উত্তর প্রান্তে আশুলিয়ার বিনোদন কেন্দ্র ফ্যান্টাসি কিংডমে ছড়িয়ে পড়েছে এক আনন্দময় প্রাণচাঞ্চল্য। হাজার হাজার কৃতী শিক্ষার্থীর উচ্ছ্বসিত সমাগমে শীতের আড়মোড়া ভেঙে নবীন প্রাণের অমিত শক্তিতে জেগে উঠেছে কল্পরাজ্যের এই রাজধানী। আজ সোমবার সকালে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দিতে প্রথম আলো এই আনন্দ উৎসবের আয়োজন করেছে শিক্ষার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘শিখো’র পৃষ্ঠপোষকতায়।

গানের সুর, বন্ধুদের সঙ্গে ছবি তোলা, লাইন দিয়ে রাইডে ওঠা আর আড্ডায় দিনের প্রথম বেলা কেটেছে শিক্ষার্থীদের। আনন্দ উপভোগের সঙ্গে মাদক, মুখস্থ ও মিথ্যাকে ‘না’ বলেছে তারা। ভালো ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে দেশকে এগিয়ে নেওয়ারও সংকল্প করেছে কৃতী শিক্ষার্থীরা।

এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কৃতী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবার ‘শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ সংবর্ধনা’ আয়োজনের শুরু হয়েছে ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে। দেশের ৬৪ জেলায় পর্যায়ক্রমে কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এরই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে আজ শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ঢাকা বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা। এতে ১৮ হাজার শিক্ষার্থীকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। আজ প্রথম দিন সংবর্ধনায় অংশ নিয়েছে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী।

শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাতসকালে ফ্যান্টাসি কিংডমে প্রবেশ করছে শিক্ষার্থীরা
ছবি: দীপু মালাকার

এবার সারা দেশে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এদের মধ্যে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী সংবর্ধনায় অংশ নিতে নিবন্ধন করেছে। প্রথম আলো যাত্রার শুরু থেকেই নতুন প্রজন্মের কৃতী শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত করতে সংবর্ধনা দিয়ে আসছে। ১৯৯৯ সালে মেধা তালিকায় সেরাদের সংবর্ধনা দেওয়া শুরু হয়েছিল। জিপিএ পদ্ধতি শুরুর পর ২০০১ সাল থেকে চলছে সারা দেশে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়ার এই বিপুল আয়োজন। এবার সংবর্ধনার আয়োজনে সহযোগিতা করছে ফ্রেশ, কনকর্ড, এটিএন বাংলা ও প্রথম আলো বন্ধুসভা। চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল লিমিটেড।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবেশপথে শিক্ষার্থীদের ভিড় বাড়ছে
ছবি: খালেদ সরকার

সকাল সাতটায় ফার্মগেট থেকে নিজেদের গাড়িতে ফ্যান্টাসি কিংডমে এসেছে সাইরা আলী ও তার মা সেলিনা আক্তার। তেজগাঁও গার্লস স্কুল থেকে বিজ্ঞানে এসএসসি পাস করেছে সাইরা। সে জানাল, প্রায় দেড় ঘণ্টা লেগেছে পৌঁছাতে। এসে মা-মেয়ে দুজনেই দারুণ উচ্ছ্বসিত। সাইরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে খাবারের কুপন নিয়ে আবার লাইন দিয়েছে রাইডের সামনে। চরকিতে উঠবে। তার বন্ধু তনুজা ঢালী আর তাসফিয়া কামরুনও এসেছে।

উৎসব মঞ্চের অনুষ্ঠান হবে বেলা একটা থেকে। তবে আনন্দ উৎসব শুরু সকাল আটটা থেকেই। ফ্যান্টাসি কিংডমে ঢোকার মুখে খোলা জায়গায় একসারি বুথ। সেখানে আগে করা নিবন্ধনপত্র দেখিয়ে প্রবেশের কুপন নিয়ে ঢুকছিল শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকেরা অবশ্য কাউন্টার থেকেই টিকিট কেটে ঢুকছিলেন। মেয়ে নাজিয়া হাসানকে নিয়ে এসেছেন পুলিশ কর্মকর্তা নূরুল হাসান। নাজিয়া ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ থেকে বিজ্ঞানে পাস করেছে। তার ইচ্ছা চিকিৎসক হবে।

তিন বন্ধু মিলে আয়নায় মুখ দেখছে
ছবি: জাহিদুল করিম

নূরুল হাসান বললেন, মেয়েকে এখানে আনার জন্য আজ ছুটি নিয়েছেন। প্রথম আলোর এই আয়োজন তার কাছে খুব ভালো মনে হয়েছে। সুন্দর–সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। এ ধরনের আয়োজন শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করবে।

ফ্যান্টাসি কিংডমের ভেতরে কৃতী শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের সমাগমে প্রাণবন্ত পরিবেশ। ঋতুর দিন গণনায় বসন্ত না এলেও পলাশ ফুলে ভরে গেছে ঐতিহ্য চত্বরের পলাশগাছ। তার নিচ দিয়ে শিক্ষার্থীরা সরি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সনদ আর খাবার নিতে। কথা হয় লতিফা বেগমের সঙ্গে। মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহাকে নিয়ে এসেছেন তিনি। বাসা শান্তিবাগ। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ স্কুল ও কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মুনতাহা। মুনতাহার খুব ইচ্ছা এই উৎসবে আসার। কারণ, তার বড় দুই বোনও আগে জিপিএ-৫ সংবর্ধনায় এসেছে।

মুনতাহার মা বললেন, এবার তার শেষবারের মতো এই অনুষ্ঠানে আসা। এর আগে ২০০৮ সালে এসেছিলেন মুনতাহার বড় দুই যমজ বোন মৌ আর মিষ্টিকে নিয়ে। ওরা ভিকারুননিসায় পড়তেন। মৌ চিকিৎসক হয়ে এখন কানাডাপ্রবাসী আর মিষ্টি বিবিএ পাস করে লন্ডনপ্রবাসী। বিয়ে হয়ে গেছে দুজনেরই। এই উৎসব খুব ভালো লাগে, তাই ছোট মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছেন।

জিপিএ-৫ কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনায় শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি
ছবি: জাহিদুল করিম

ঐতিহ্য চত্বরের পাশেই প্রথম আলো পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের বুথ। সেখানে থেকে বিশেষ প্যাকেজে কিশোর আলো ও বিজ্ঞান চিন্তা—এই দুই ম্যাগাজিন ছয় মাস ও এক বছরের জন্য পাওয়া যাচ্ছে। ছয় মাসের প্যাকেজে নিলে পাওয়া যাবে সাত মাসের ম্যাগাজিন এবং এক বছরের প্যাকেজে পাওয়া যাবে ১৪ মাসের ম্যাগাজিন।

মণিপুর স্কুলের জোয়ারদার সাকিরুল নবী ও তার চাচাতো ভাই জোয়ারদার আবু রাইয়ান বিজ্ঞান চিন্তার এক বছরের প্যাকেজ নিয়েছে। তারা জানাল, বিজ্ঞান চিন্তার তারা নিয়মিত গ্রাহক। এখানে প্যাকেজে সুবিধায় ১ বছরের টাকায় ১৪ মাসের ম্যাগাজিন পাওয়ার সুযোগ নিয়েছে তারা।

বাসায় নিয়মিত প্রথম আলো বা ম্যাগাজিন রাখতে চাইলে এখানে নাম–ঠিকানা নিবন্ধন করার সুযোগ রয়েছে। এতে বাসায় নিয়মিত পত্রিকার বা ম্যাগাজিন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হবে বলে বুথের কর্মীরা জানালেন।

সংবর্ধনা মঞ্চে আলোচনা–সংগীত

দুপুরের খাবারের পর সংবর্ধনা মঞ্চে শুরু হয় আলোচনা আর সংগীতের জমকালো আয়োজন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সুমনা শারমীন। সহযোগী ছিলেন মৌসুমী মৌ। সঞ্চালনায় এই পর্বে স্বাগত বক্তব্য দেন কথাশিল্পী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ভালো ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি সবাইকে ভালো মানুষ হতে হবে।

আলোচনায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভিনসেন্ট চ্যাং শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে তাদের সালাম দেন। তিনি ছাত্রদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের প্রস্তুত করার পরামর্শ দেন।

ফ্যান্টাসি কিংডমে সংসদ ভবনের আদলে তৈরি করা স্থাপনার সামনে শিক্ষার্থীদের ছবি তুলে দিচ্ছেন এক অভিভাবক
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ শিক্ষার্থীদের বলেন, ‘তোমরা জীবনের প্রথম একটি বড় পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করেছ। কিন্তু এখানেই থামলে চলবে না। সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ, বড় পরীক্ষা সেখানেও সফল হতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের সাবেক অধ্যাপক অমল কৃষ্ণ হালদার শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমারাই দেশের ভবিষ্যৎ। তোমাদের শক্তির ওপর ভর করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তোমরা নিজেদের ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারলেই বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।’

কৃতী শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন নন্দিত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। তিনি বললেন, ‘তোমরা যখন যা কিছুই করবে মন দিয়ে করবে, ভালোবেসে করবে। ভবিষ্যতে তোমারা অনেক বড় হবে।’

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে পেয়ে শ্রোতা–দর্শকেরা গান শুনতে চাইবে না, তাই হয় নাকি! অনুরোধ এল বিপুল। কিন্তু তিনি শিক্ষার্থীদের বললেন, ‘আজ তোমরা গাইবে, আমিই বরং গলা মেলাব।’ এই বলে তিনি শুরু করলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…। শিক্ষার্থীরা তো গাইলোই, তাদের সঙ্গে আসা অভিভাবকেরাও বাদ গেলেন না, গলা মেলালেন অনেকেই।

অনুষ্ঠানের আলোচনা পর্বে আরও অংশ নেন শিখোর সহপ্রতিষ্ঠাতা জিসান জাকারিয়া, কনকর্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার কামাল, চরকির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেদওয়ান রনি। শিক্ষার্থীদের মাদকের প্রতি ‘না’, মুখস্থের প্রতি ‘না’ ও মিথ্যার প্রতি ‘না’ বলার অঙ্গীকার করান প্রথম আলোর যুব কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়কারী মুনির হাসান।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমাদের চাওয়া সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের জয়। সেই জয়কে তোমরাই তোমাদের মেধা–মনন আর অদম্য মনোবল দিয়ে ছিনিয়ে আনবে।’ তিনি শিক্ষার্থীদের মা–বাবা, অভিভাবক, শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

রাইডে ওঠার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীরা
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

অনুষ্ঠান চলছিল গান আর তার ফাঁকে ফাঁকে বিশিষ্টজন আর তারকাদের কথোপকথন দিয়ে। শুরু করেছিলেন রুপালি পর্দার তারকা ফেরদৌস আহমেদ। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার পাশাপাশি বই পড়া, গান শোনা, সাংস্কৃতিক চর্চার প্রয়োজনীয়তার দিকটি তুলে ধরেন।

পরে গান পরিবেশন করেন দিনাত জাহান মুন্নী। ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে’ এবং ‘দুঃখটাকে দিলাম ছুটি’ ইত্যাদি গান তিনি পরিবেশন করেন। পরে মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী। তারা শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানান।

পরে গান পরিবেশন করেন ইমরান মাহমুদুল, পান্থ কানাই ও অনিমেষ রায়। সবশেষ মঞ্চ মাতিয়েছে জলের গানের শিল্পীরা। তাঁরা গেয়েছেন—‘এমন যদি হতো’, আমি এক পাগলা’ ও ‘বকুল ফুল বকুল ফুল’।

উৎসব দ্বিতীয় দিন

আগামীকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানও ফ্যান্টাসি কিংডমেই শুরু হবে সকাল আটটায়। অতিথি থাকবেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য তানভীর হাসান ও শিখো সহপ্রতিষ্ঠাতা জিসান জাকারিয়া।

সংস্কৃতিপর্বে মঞ্চ মাতাবেন ব্যান্ডদল চিরকুট, আরিফিন শুভ, আফরান মৃধা, কোনাল, ঋতুরাজ, নন্দিতা, আফসান আরা বিন্দু ও অবন্তী সিঁথি।