গ্রাম ও শহর: বৈষম্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া যেখানে চলমান
তথ্যে-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, আর্থসামাজিক সূচকে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য কমছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) ‘স্টেট অব দ্য রিয়েল ইকোনমি’ শীর্ষক জাতীয় সমীক্ষায় দেখা যায়, গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ভালো অগ্রগতি অর্জন করেছে। সম্ভবত এ অগ্রগতির মূল উপাদান পাকা সড়ক নেটওয়ার্ক এবং দেশব্যাপী বিদ্যুৎ-সংযোগ। সেই সঙ্গে মানুষের মনে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা।
পিপিআরসির ওই সমীক্ষায় উল্লেখিত অগ্রগতি মানুষের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগ প্রমাণ করেছে। এই অর্জিত অগ্রগতি ধরে রাখতে হবে। জুলাই-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে রাজনৈতিক সংস্কার যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কার ততটা পায়নি। জুলাই আন্দোলন কেবল রাজনৈতিক ছিল না, এর গভীরে ছিল অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
ব্যবসায় ভীতিকর অবস্থা
দেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, চাঁদাবাজি, লুটপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল বা মালিকানার হাতবদল বৃহৎ, মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের ভীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিয়েছেন বা সংকুচিত করেছেন। এ কারণে স্থানীয় পর্যায়ে টাকার প্রবাহ কমেছে। দ্বিতীয়ত, কিছুসংখ্যক ব্যাংকের নাজুক অবস্থার কারণে প্রান্তিক বিনিয়োগকারীরা বেশ বিপাকে পড়েছেন। তৃতীয়, সরকারি অনেক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে, নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে এসেছে। ফলে প্রান্তিক পর্যায়ে শ্রমজীবী মানুষের কাজের সুযোগ কমেছে।
পিপিআরসির সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে অর্থাৎ টাকার দাম কমেছে। সার্বিক অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি চাপে পড়েছে, গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে শহরে এসে অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত হচ্ছেন। গ্রাম-শহরের মধ্যে নানা সূচকের বৈষম্য কমলেও গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের অভাবে সেই অগ্রগতি পেছনের দিকে ফিরতে শুরু করেছে। যেমন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এ দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮ দশমিক ৭। আর পিপিআরসির ২০২৫-এর সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, সে হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে।
পিপিআরসির সমীক্ষায় পরিলক্ষিত গ্রাম-শহর বৈষম্যের বিশেষ কয়েকটির দিকে নজর দেওয়া যাক। গৃহ ক্যাটাগরিতে দেখা যাচ্ছে, গ্রামের ১৬ দশমিক ৬ এবং শহরের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা পাকা বাড়িতে বাস করেন। গ্রামের ৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ ও শহরের ২৯ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা টিনশেড বাড়িতে বাস করেন। গ্রাম এলাকার ৯১ দশমিক ৫ ভাগ উত্তরদাতা ও শহরের ৫৯ দশমিক ৮ ভাগ উত্তরদাতা নিজগৃহে বাস করেন। এসব তথ্য থেকে সম্পদের মালিকানা বৃদ্ধির একটি বিশেষ দিক উঠে এসেছে।
সুপেয় পানি পাওয়ার ক্ষেত্রে শহরের তুলনায় গ্রাম সামান্য এগিয়ে আছে। গ্রামের উত্তরদাতাদের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৬ শতাংশ সুপেয় পানি পান, অন্যদিকে শহরে এই হার ৯৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বিদ্যুৎ–সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। গ্রামে বিদ্যুৎ-সংযোগের হার ৯৮ দশমিক ৩, শহরের ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ। কিন্তু বিদ্যুৎ-সংযোগ শেষ কথা নয়। বিদ্যুৎ থাকা ও না-থাকার (লোডশেডিং) ক্ষেত্র গ্রাম ও শহরের চিত্র এক নয়।
শহর ও গ্রামে চিকিৎসা ব্যয় বেশি
মাসিক আয়ের ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের উত্তরদাতাদের মধ্যে পার্থক্য হলো যথাক্রমে ২৯,২০৫: ৪০,৫৭৮ টাকা। শহরের উত্তরদাতাদের মধ্যে আয়ের চেয়ে ব্যয় করার প্রবণতা বেশি; গ্রামের উত্তরদাতারা সঞ্চয়প্রবণ। উত্তরদাতাদের আয়ের বেশির ভাগ ব্যয় হয় খাবারের পেছনে। শহরবাসী ও গ্রামবাসী উভয় শ্রেণির উত্তরদাতাদের চিকিৎসার ব্যয় বেড়েছে। জীবনযাপনের ধরনের সঙ্গে সম্পর্কিত রোগ বেড়েছে উভয় শ্রেণিতেই—ব্লাড প্রেশার, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও হৃদ্রোগের বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। শিক্ষার ব্যয় শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি।
পিপিআরসির ওই সমীক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্মার্টফোন ব্যবহারের হার গ্রামে ৭১ শতাংশ, আর শহরে ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ। কম্পিউটার/ল্যাপটপ রয়েছে গ্রামের ২ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতার। শহুরে উত্তরদাতাদের মধ্যে এর হার ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। গ্রামের ৭৬ দশমিক ৮ এবং শহরের ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ খানার যুবকদের স্মার্টফোন রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করেন গ্রামের ৬৫ দশমিক ৪১ শতাংশ উত্তরদাতা; শহরে এই হার ৭৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এসব তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির এক নতুন দিকের সন্ধান দিচ্ছে। ব্যয় ও ভোগের ধরনের ক্ষেত্রে বৈষম্য গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।
বাংলাদেশে ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত সম্পদের মালিকানা বাড়ছে। সিংহভাগ অর্থ পুঞ্জীভূত হচ্ছে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে। বৈষম্য বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলমান। বিদ্যমান আইন, নীতি-পরিকল্পনা জনগণের স্বার্থ রক্ষার চেয়ে গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় অধিকতর কার্যকর। এ জটিল অর্থনৈতিক সমীকরণের মধ্যে গ্রাম-শহর সমতা বা অসমতার চিত্র কীভাবে দেখা হবে, তা এক কঠিন প্রশ্ন।
কারণ, যোগসাজশের অর্থনীতির সূতিকাগার হলো শহর, গ্রাম তার জোগানদাতা। গ্রাম শুষে শহর ঝকঝকে হয়ে উঠছে। শহরের একশ্রেণির মানুষ বিত্তবৈভবের মালিক হচ্ছেন। গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য সাদা চোখ বা কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে দেখা সহজ নয়। যেমন গ্রামাঞ্চলে প্রকল্পভিত্তিক যে চাষাবাদ শুরু
হয়েছে, তাতে অর্থলগ্নিকারী হলেন শহর বা আধা শহরের বিত্তবান। এ চাষাবাদের সঙ্গে জমির মালিক, মধ্যস্বত্বভোগী/গভীর নলকূপের অপারেটর এবং প্রকল্পের অর্থলগ্নিকারী জড়িত। কোনো প্রজেক্টের আওতায় একজন কৃষকের এক বিঘা জমি থাকলে তাঁর স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করা কঠিন হচ্ছে।
গভীর নলকূপের অপারেটরের সঙ্গে প্রকল্পে অর্থ লগ্নিকারীর রয়েছে বিশেষ যোগসাজশ। ফলে কৃষক চাইলেই নিজের জমি ইচ্ছেমতো চাষাবাদ করতে পারছেন না। কাগজপত্রে কৃষকের জমির মালিকানা থাকছে, কিন্তু বাস্তবে তিনি চাষাবাদের স্বাধীনতা হারাচ্ছেন। এভাবেই শহুরে বা আধা শহরের পুঁজির প্রবেশ ঘটছে গ্রামে। কৃষিতে একধরনের নয়া উপনিবেশবাদ সৃষ্টি হয়েছে।
পুকুর বা ঘের লিজের নামে লিজ লাভকারী জলাধারের ওপর একচেটিয়া মালিকানা লাভ করছেন। এসব জলাধার থেকে কেউ এক ছটাক পানি নিতে পারেন না। ফলে খরা মৌসুমে জলাধারসংলগ্ন চাষের জমিগুলো ঝুঁকিতে পড়ে। মোটকথা, গ্রামকে শাসিয়ে শহরের জোগানের উপযোগী করা হচ্ছে। গ্রাম তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারাচ্ছে। পাবলিক প্রপার্টির ওপর জনগণের মালিকানাবোধ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
গ্রাম ও শহরের বৈষম্য সমতাভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও গণতন্ত্রের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই স্টিগলিৎজ তাঁর দ্য গ্রেট ডিভাইড গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বৈষম্য সমাজে বিভাজনের মূল কারণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক নীতিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছিল। কর্মসূচিভিত্তিক উন্নয়ন-পরিকল্পনা ছিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শন। সে জায়গা থেকে সরে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পভিত্তিক অ্যাডহক অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে প্রকল্পশাসিত দেশ।
সাধারণ মানুষের স্বার্থে কম গুরুত্ব পায়
বাংলাদেশ যে নব্য-উদারনৈতিক উন্নয়নের নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ কম গুরুত্ব পাচ্ছে। মোহাম্মদ তানজিমুদ্দিন খান এবং মোহাম্মদ সাজ্জাদুর রহমান তাঁদের নিউ লিবারেল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে দেখিয়েছেন, কীভাবে বাংলাদেশি সমাজ ‘কল্যাণবাদ’ থেকে ‘বিপণন/পণ্যায়নে’ রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে লাভ ও প্রতিযোগিতার যুক্তিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নির্ধারিত হয়।
যুগপৎভাবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ তাঁর ডেভেলপমেন্ট রি-এক্সামিনড: কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড কনসিকুয়েন্সেস অব নিউ লিবারেল বাংলাদেশ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, আইন ও রাষ্ট্র পুঁজি সঞ্চয়ের জন্য অশোধিত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এ কারণে ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্ররা হচ্ছে আরও দরিদ্র। সমাজের এক অংশ যখন প্রচুর সম্পদের মালিক হচ্ছে, অন্য অংশ তখন মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য লড়াই করছে। মাথাপিছু আয় বাড়লেও সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত হচ্ছে না।
বৈষম্য নাগরিকদের মধ্যে অস্থিরতা ও বঞ্চনাবোধ বাড়িয়ে দেয়। প্রকৃতপক্ষে তা বৈষম্য আরও প্রসারিত করে। মানবিক ও মর্যাদাপূর্ণ সমাজ গড়তে সমতাভিত্তিক ও কল্যাণমুখী অর্থনীতি এক উন্নত বিকল্প। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহজ ও সঠিক পথ ধরতে হবে।
খান মো. রবিউল আলম: যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক