দুই ধারায় আপত্তি রেখেই হচ্ছে সিডও প্রতিবেদন

বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব আইনে নারীকে সম–অধিকার দেওয়ার প্রশ্নে সরকারের অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি।

  • প্রথমে চারটি ধারায় আপত্তি থাকলেও দুটি ধারা তুলে নেওয়া হয়।

  • মন্ত্রণালয়ের প্লাউ বিভাগ সিডওতে জমা দিতে নবম প্রতিবেদন তৈরি করছে।

  • করোনা মহামারির কারণে এবার প্রতিবেদন দিতে দেরি।

নারী নির্যাতনপ্রতীকী ছবি

নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) স্বাক্ষরের ৩৮ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু দুটি ধারায় এখনো আপত্তি প্রত্যাহার করেনি সরকার। দুটি ধারায় আপত্তি রেখেই নিয়ম অনুসারে সিডও কমিটিতে জমা দিতে নবম প্রতিবেদন তৈরি করছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

ওই দুটি ধারা অনুসারে, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব আইনে নারীকে সমান অধিকার দেওয়ার প্রশ্নে সরকার অবস্থান পরিবর্তনের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

নারী অধিকারকর্মীদের মতে, নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখতে সিডওর দুটি ধারায় সরকার আপত্তি প্রত্যাহার করছে না। নারীর জীবনে বহুমাত্রায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এরপরও নারীর সম–অধিকারের প্রত্যাশা নিয়ে আজ ৩ সেপ্টেম্বর শনিবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সিডও দিবস।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হাসানুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই মুহূর্তে বলার মতো কোনো পরিবর্তন নেই। নারীর কল্যাণে আপত্তির জায়গা ও দাবির বিষয়গুলোকে সামঞ্জস্য করে কতটা পরিবর্তন আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে করণীয় ঠিক করতে আবারও পরামর্শ সভা ডাকা হবে।

তবে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালেও সব পক্ষকে নিয়ে পরামর্শ সভা করেছিল মন্ত্রণালয়। কোনো অগ্রগতি ছাড়াই সেই বৈঠক শেষ হয়।

১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সিডও সনদ কার্যকর হয়। সরকার ১৯৮৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এটি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে। শুরুতে চারটি ধারার ওপর আপত্তি ছিল। পরে ২ ও ১৬ (১) (গ) ধারার ওপর আপত্তি রেখে বাকি দুটি থেকে তুলে নেওয়া হয়। সিডও সনদের ২ ধারায় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে আইনের সংস্কার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া এবং ১৬ (১) (গ) ধারায় বিয়ে ও পারিবারিক আইনে সম–অধিকারের কথা বলা হয়।

মন্ত্রণালয়ের পলিসি লিডারশিপ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ইউনিট (প্লাউ) নবম প্রতিবেদন তৈরি করছে। সিডও সনদ বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলে ধরে চার বছর পরপর সরকারগুলো সিডও কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্লাউ শাখার প্রোগ্রাম অফিসার জীবুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৯ সালে সিডও কমিটিকে নবম প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। তবে করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের কারণে সেই সময়সীমা শিথিল করা হয়। নবম প্রতিবেদন দ্রুত তৈরির জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান উম্মে বুশরা ফাতেহা সুলতানাকে পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিডওর নবম প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করেছি। এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে সিডও সনদের মূল স্পৃহার প্রতি লক্ষ্য রেখেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ সিডও কমিটিকে এ পর্যন্ত ছয়টি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিবেদন দেয়নি। এর আগের পাঁচটি প্রতিবেদনে সরকার দুটি ধারার ওপর আপত্তির বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করে লিখেছিল, ‘বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনাধীন।’

তবে ২০১৫ সালে অষ্টম প্রতিবেদনে সরকার আপত্তির বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে জানায়, বিভিন্ন ধর্মীয় বিধান ও বিশ্বাসের আলোকে পারিবারিক আইন তৈরি করা হয়েছে। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্য রয়েছে। পারিবারিক আইনে পরিবর্তন আনতে হলে সব ধর্মের নেতাদের সম্মতি প্রয়োজন। সমাজ এখনো এসব পরিবর্তন গ্রহণে প্রস্তুত নয়।

নারী সংগঠনগুলোর আপত্তির মুখে ২০২১ সালে মন্ত্রণালয় ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদনে ওই বাক্যগুলোতে পরিমার্জন এনে ‘সমাজ প্রস্তুত নয়’ বাক্যটি বাদ দেয়।

এত বছরেও সিডওর পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সিডও নারীর প্রতি রাষ্ট্রীয়, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনগত বৈষম্য দূর করার কথা বলেছে। সেখানে সরকার দুটি ধারায় আপত্তি বহাল রাখায় নারীর জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইনের কারণে চারপাশে নারীর প্রতি বৈষম্যের নানা দৃষ্টান্ত তৈরি হচ্ছে। নারীর নিজের জীবনে কোনো কিছু পছন্দ করে নেওয়ার অধিকার সম্পূর্ণ অস্বীকৃত। সংবিধানে যে সমতার অঙ্গীকার করা হয়েছে, সেটিও নারী ভোগ করতে পারছে না।

দুটি ধারায় সরকারের আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে সুলতানা কামাল বলেন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণের কথা বললে বলা যায়, সরকারের নীতিনির্ধারণে যাঁরা আছেন, তাঁরাও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব থেকে মুক্ত নন। নারীর সম–অধিকারের বিষয়টি তাঁরা গ্রহণ করতে পারেন না, দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। আর রাজনৈতিক কারণ হচ্ছে, নারীবিদ্বেষী প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে রাজনৈতিক শক্তি নতজানু। তারা মৌলবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে আপসের কৌশল নিয়েছে।