দেশে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বহুমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন: গবেষণা

ছবি: সংগৃহীত

দেশে কার্যকরভাবে যক্ষ্মা মোকাবিলায় স্ক্রিনিং এবং কেস ফলোআপ, ভার্চ্যুয়াল কেয়ার ও ডিজিটাল স্বাস্থ্য, কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো এবং স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের প্রশিক্ষণের দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) ফেলোশিপ গবেষণায় বিষয়গুলো উঠে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়।

আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ইউএসএআইডি ‘অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিবি ইন বাংলাদেশ’ (এসিটিবি) কার্যক্রম আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে ফেলো গবেষকেরা তাঁদের যক্ষ্মাবিষয়ক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার। এ ছাড়া ইউএসএআইডির জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মিরান্ডা বেকমেন, আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ ও সংক্রামক রোগ বিভাগের জ্যেষ্ঠ পরিচালক ফেরদৌসী কাদরী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

রাজধানীতে বসবাসকারী ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ওষুধ সংবেদনশীল এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব নিয়ে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষক আজিজুর রহমান শারাক। ২০২০ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পরিচালিত ক্রস-সেকশনাল পদ্ধতির গবেষণায় তিনি ৯৩ জন ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা রোগীর পরিবারের ৩৫৫ সদস্যের সাক্ষাৎকার নেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ৯ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবারের সদস্যের যক্ষ্মার লক্ষণ ছিল এবং পরবর্তী সময়ে এর মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশের যক্ষ্মা শনাক্ত হয়।

বিএসএমএমইউর ফেলো গবেষক ফারিহা আলম মিহিকা রাজধানীর নির্দিষ্ট এলাকায় ফুসফুসীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ পরিষেবার ওপর করোনা মহামারির প্রভাব নিয়ে করা গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন। তিনি ছয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও যক্ষ্মা রোগীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর সময়কালে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি এ গবেষণা করেন।

দেখা যায়, করোনায় যক্ষ্মা স্ক্রিনিং উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয় (১৬ থেকে ৩৫ শতাংশ)। সেবাগ্রহীতারা বিধিনিষেধে সৃষ্ট পরিবহনসংকট (৯৫ শতাংশ) এবং করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির বিষয়টিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেন। অপর দিকে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাদানকারীর অভাব, কাজের চাপ বৃদ্ধি ও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।

রাজধানীতে শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্তকরণের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে গবেষণা করেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) গবেষক মো. ইমতিয়াজ উদ্দিন। গবেষণায় তিনি যক্ষ্মা আক্রান্ত শিশু, তাদের মা–বাবা এবং স্বাস্থ্যসেবাদানকারী মিলিয়ে ৩২ জনের সাক্ষাৎকার নেন। দেখা যায়, সামাজিক ও প্রচলিত ভুল ধারণা, শিশুদের যক্ষ্মা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, কন্ট্যাক্ট ইনভেস্টিগেশন ও রোগ নির্ণয়ে সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাদানকারী এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা শিশু যক্ষ্মা শনাক্তকরণের বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ও রোগীর মধ্যে ওষুধ–প্রতিরোধী যক্ষ্মাবিষয়ক জ্ঞান ও মনোভাব সম্পর্কিত গবেষণা উপস্থাপন করেন নিপসমের গবেষক মমতাজ বেগম। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়কালে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি গবেষণাটি করেন। তিনি এ গবেষণায় ২৩২ জনের সাক্ষাৎকার নেন। এর মধ্যে ১০১ জন স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং ১৩১ জন রোগী। সমীক্ষায় দেখা যায়, ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা সম্পর্কে ৯৩ শতাংশ চিকিৎসক ভালো জানেন। প্রায় ৬৯ শতাংশ নার্স এবং ৮২ শতাংশ রোগী এই বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন।

অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আনোয়ার হোসেন হাওলাদার সিটিবি ফেলোশিপ উদ্যোগের প্রশংসা করেন। গবেষকদের তাঁদের এই প্রচেষ্টার জন্য সাধুবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকের উপস্থাপিত এসব গবেষণা থেকে আমরা দেখলাম, গবেষণার পাশাপাশি গবেষণালব্ধ ফলাফল আমাদের কার্যক্রমসমূহে বাস্তবায়ন করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও বাংলাদেশের যক্ষ্মা পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব হবে।’

মিরান্ডা বেকমেন বলেন, ‘যক্ষ্মা নিয়ে অনেক সামাজিক ভুল ধারণা আছে। যক্ষ্মা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, শনাক্ত ও চিকিৎসার মাধ্যমে যে যক্ষ্মায় মৃত্যুহার কমানো যায়, তা এসব গবেষণায় উঠে এসেছে। করোনার টিকা, চিকিৎসা ও এ–বিষয়ক নানা গবেষণা ও নতুন জ্ঞান উদ্ভাবন—এর সবই সম্ভব হয়েছে করোনা পরিস্থিতির প্রতি আমাদের গুরুত্বারোপের ফলে। যক্ষ্মার ক্ষেত্রেও এসব ফলাফল পাওয়া যেতে পারে, যদি যক্ষ্মা নির্মূলে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, আগ্রহ ও মনোযোগ দেওয়া যায়।’

আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক তাহমিদ আহমেদ ফেলোদের কাজের প্রশংসা করেন এবং তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফলের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘এই ফেলোশিপ স্বাস্থ্যসেবায় কর্মরত পেশাজীবীদের যক্ষ্মা গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে সহায়তা করছে। উদ্যোগটি তরুণ গবেষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা স্বতন্ত্রভাবে চিকিৎসা গবেষণা করতে পারেন।’

আইসিডিআরবি ইউএসএআইডির এসিটিবি, বিএসএমএমইউ ও নিপসমের উদ্যোগে চারজন স্নাতকোত্তর চিকিৎসক/শিক্ষার্থীদের যক্ষ্মাবিষয়ক গবেষণার জন্য এই ফেলোশিপ প্রদান করা হয়।