দাঁড়াতে পারেন না, আছে আরও সমস্যা, তবু পিছিয়ে নেই খালেদ

খালেদ মাহমুদ খান
ছবি: খালেদ মাহমুদের সৌজন্যে

ওয়াকারে চেপে ঘরময় ছুটে বেড়ায় এক বছরের মেয়ে সোহা। তার পাশে পাশে হাঁটুতে ভর দিয়ে এগিয়ে চলেন বাবা খালেদ মাহমুদ খান। এ সময় তাঁদের দুজনকে প্রায় সমান উচ্চতার মানুষ বলেই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে খালেদ বলেন, ‘আমি শারীরিক প্রতিবন্ধী আর মেয়েটা হাঁটা শিখছে। বাপ-বেটি দুজনেরই এখন একই অবস্থা। দুজনেই হামাগুড়ি দিই। এটা যতটা কষ্টের, ততটাই আনন্দের।’

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খালেদ মাহমুদ খানের কিছু ছবি ছড়িয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি হাঁটছেন, কখনো ফসলের মাঠে কাদায় পা ডুবিয়ে ধান লাগাচ্ছেন। আবার কখনো গাছতলা দিয়ে চলেছেন বাইসাইকেল চালিয়ে। কিন্তু বাস্তবে চল্লিশ বছর বয়সী এই মানুষটি হাঁটতে পারেন না। প্রায় ১৮ বছর আগে পুরোপুরিভাবে দুই পায়ে চলার শক্তি হারিয়েছেন তিনি। তার ওপর শরীরে বাসা বেঁধেছে টিনিটাস নামের ব্যাধি।

খালেদ মাহমুদ খানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কোনো আশ্চর্য ঘটনায় যদি পা দুটি ফিরে পান, কী করবেন? উত্তরে বললেন, ‘এসব স্বপ্নের কথা। তবু যদি ধরেন, পেয়েই যাই, তাহলে প্রথমে আমার মেয়েটাকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটব। কারণ, আমি ওর সুপারম্যান বাবা।’

টিনিটাসে আক্রান্তরা চারদিক নিস্তব্ধ থাকার পরও কানে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পান। এ রোগের কারণে কখনো টানা এক ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারেন না খালেদ। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ঘরের বাইরে গিয়ে উপার্জনের সুযোগও নেই তাঁর। অথচ তিন সদস্যের পরিবারের পুরো খরচই তাঁকে বহন করতে হয়। জীবনের এই কঠিন সংগ্রামের মধ্যেও হাল ছাড়েননি খালেদ। ইতিবাচক মনোভাবের কারণে অনেকের কাছে তিনি প্রেরণার বাতিঘর।

বাংলাদেশ-ভারতের অনেক শিল্পী খালেদের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেছেন। একসময় তিনি নিয়মিত প্রযুক্তি ও রাজনীতি নিয়ে লিখতেন। তাঁর সম্পাদনা করা ছয় শর বেশি ভিডিও পাওয়া যাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। খালেদের কয়েকটি পোস্ট সম্প্রতি ভাইরাল হয়েছে। এসব পোস্টে মন্তব্য করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। শত শত মানুষ তাঁর লেখা শেয়ার করেছেন। এই জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল একটাই কথা—দৃঢ় মানসিকতা আর জীবনের প্রতি প্রবল ইতিবাচক মনোভাব।

খালেদ মাহমুদ তাঁর প্রতিটি পোস্টে মূল ঘটনার সঙ্গে একটি বার্তা দেন। বার্তাটি হলো—তিনি একজন সুখী মানুষ। তাঁকে যেন কেউ করুণার চোখে না দেখে এবং জীবনে তিনি যা পাননি, তার জন্য আক্ষেপ নেই। তবে মাঝেমধ্যে ভীষণ ইচ্ছা করে হাঁটতে। তখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে পা সমেত নিজের ছবি তৈরি করেন। সেসব ছবিকে সত্যি বলে ভাবতে তাঁর ভালো লাগে। তবে এসব ছবি দেখে তাঁর স্ত্রীর ভীষণ মন খারাপ হয়।

টিনিটাসে আক্রান্তরা চারদিক নিস্তব্ধ থাকার পরও কানে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পান। এ রোগের কারণে কখনো টানা এক ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে পারেন না খালেদ। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে ঘরের বাইরে গিয়ে উপার্জনের সুযোগও নেই তাঁর। অথচ তিন সদস্যের পরিবারের পুরো খরচই তাঁকে বহন করতে হয়।

খালেদ সেরিব্রাল পালসিতে (মস্তিষ্কে পক্ষাঘাত) আক্রান্ত। ২০০৭ সালে এই রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়েই হিতে বিপরীত হয়। ভুল অস্ত্রোপচারে দুই পায়ের চলার শক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন তিনি। খালেদের দাবি, আগে অন্য কিছুর সহায়তা নিয়ে যেটুকু হাঁটতে পারতেন, অস্ত্রোপচারের পর তাও শেষ হয়ে যায়।

২০২২ সালে খালেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আয়শা খান
ছবি: খালেদ মাহমুদের সৌজন্যে

এখন দুই হাঁটুতে ভর করে মেয়ে সোহাকে সারা দিন পাহারা দেন। মেয়েটা ওয়াকার নিয়ে দ্রুত ছোটাছুটি করলে তাল মেলাতে কষ্ট হয় খালেদের। তবে এই কষ্টও তাঁর জন্য আনন্দের। আবেগ ভরা গলায় বলেন, ‘জানেন! আমার এক বছরের মেয়েটি আমার বুকের ওপর ঘুমায়।’

খালেদ থাকেন টাঙ্গাইলের করোটিয়ায়। টাঙ্গাইলের একটি কলেজ থেকে সমাজকল্যাণে স্নাতক শেষ করেছেন ২০১৩ সালে। তাঁর পক্ষে ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব না। তাই বাড়িতে বসে ফ্রিল্যান্সিং করেন। প্রযুক্তিবিষয়ক সমস্যার সমাধান, ভিডিও সম্পাদনা এবং লেখালিখি তাঁর কাজের ক্ষেত্র। নিজের উপার্জন দিয়ে সংসারের খরচ চালান তিনি। স্ত্রী-সন্তানের পাশাপাশি খালেদের সঙ্গে তাঁর মাও থাকেন।

দুই হাঁটুতে ভর করে মেয়ে সোহাকে সারা দিন পাহারা দেন। মেয়েটা ওয়াকার নিয়ে দ্রুত ছোটাছুটি করলে তাল মেলাতে কষ্ট হয় খালেদের। তবে এই কষ্টও তাঁর জন্য আনন্দের।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মায়ের একটি ছবি পোস্ট করে খালেদ লিখেছেন, ‘শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমার পক্ষে হজ পালন করা দুঃসাধ্য। এই পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমার আম্মা আমার হয়ে বদলি হজ করে দেন। আম্মা নিজেই সুস্থভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন না। তিনি অনেকটা পথ হেঁটে আর হুইলচেয়ারে বসেই এ কাজটি সম্পন্ন করেন। এরপর আর আমি আম্মার কাছে কিছু চাইনি। মূলত এর পরে এক জীবনে আম্মার কাছে আমার আর কোনো চাওয়া নেই।’

এ বছরের জানুয়ারিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন খালেদ। ওই সময় তাঁর কম্পিউটারের হার্ডডিস্কও নষ্ট হয়ে যায়। বেশ বিপাকে পড়েন তিনি। তবে দমে যাননি। হাসিমুখে আবারও ফিরেছেন জীবনের কাছে। এই অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণেই পরিচিতদের কাছে তিনি প্রিয় মুখ।

বাবা খালেদ মাহমুদ খানের কোলে এক বছরের কন্যা সোহা
ছবি: খালেদ মাহমুদের সৌজন্যে

২০১১ সালের দিকে প্রযুক্তিবিষয়ক পরামর্শ নিতে গিয়ে খালেদের সঙ্গে পরিচয় হয় ইউসিবি ব্যাংকের কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালেদ মাহমুদ খানের যে আত্মবিশ্বাস, তা অনেক সুস্থ মানুষের মধ্যেও থাকে না। কেউ উপহাস করলেও তিনি তাঁকে সম্মান করেন। এ কারণেই মনে হয়, খালেদ ভাই মানসিকভাবে আমাদের অনেকের চেয়ে বেশি সুস্থ মানুষ।’

খালেদ মাহমুদ খানের জীবনের অনেক ঘটনার সাক্ষী দিনাজপুরের বৈকালী নাট্যগোষ্ঠীর নাট্য সম্পাদক ও আবৃত্তিশিল্পী জাকির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিভা কোনো প্রতিবন্ধকতা মানে না, যার দৃষ্টান্ত খালেদ। তাঁকে ২০১১ সাল থেকে চিনি। খালেদ খুব ভালো মানুষ। না হলে এভাবে লিখতে পারতেন না।’

এ বছরের জানুয়ারিতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন খালেদ। ওই সময় তাঁর কম্পিউটারের হার্ডডিস্কও নষ্ট হয়ে যায়। বেশ বিপাকে পড়েন তিনি। তবে দমে যাননি। হাসিমুখে আবারও ফিরেছেন জীবনের কাছে।

২০২২ সালে খালেদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন আয়শা খান। ২০২৪ সালের অক্টোবরে এই দম্পতির ঘর আলোকিত করেছে একটি কন্যাসন্তান। সোহা নামের সেই সন্তানটি এখন খালেদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় প্রেরণা। সন্তানের দেখভাল করতে তাঁর চেষ্টায় এতটুকু কমতি নেই যেন। ওয়াকারে ভর দিয়ে শিশু সোহা যেদিকে ছুটে যায়, হাঁটুতে ভর দিয়ে সেদিকেই এগিয়ে যান তিনি। খুব আগ্রহ নিয়ে বলেন, ‘আমার মেয়ে এত ছোট যে ও বুঝতে পারে না, ওর বাবার উচ্চতা কম না বেশি। হয়তো ভাবে, বাবা ওর বয়সেরই একজন। খুশিই হয় আমাকে ছোট দেখে। তবে মেয়ে আমাকে সুপারম্যান ভাবে। আমার সব কথা শোনে।’

খালেদ মাহমুদ খানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কোনো আশ্চর্য ঘটনায় যদি পা দুটি ফিরে পান, কী করবেন? উত্তরে বললেন, ‘এসব স্বপ্নের কথা। তবু যদি ধরেন, পেয়েই যাই, তাহলে প্রথমে আমার মেয়েটাকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ হাঁটব। কারণ, আমি ওর সুপারম্যান বাবা।’