বিমানবন্দরে চুরি হওয়া সোনার দাম কত, ক্ষতি কার এবং একটি প্রশ্ন

সোনার বার
ফাইল ছবি

এক কেজি বা দুই কেজি নয়, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের শুল্ক বিভাগের লকার থেকে চুরি গেছে পাক্কা ৫৫ কেজি সোনা। এই সোনার দাম কত, তা জানলে আপনার চোখ কপালে উঠবে।

জানা দরকার আসলে ক্ষতিটা কার হলো—মানুষের না সরকারের। আর বিমানবন্দরে উদ্ধার হওয়া সোনার গন্তব্য কী, সেটাও জেনে রাখতে পারেন।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) গত ২৫ আগস্ট সোনার নতুন দাম ঘোষণা করে। এতে ২২ ক্যারেট মানের প্রতি গ্রাম সোনার দাম নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার ৬৮০ টাকা। এক হাজার গ্রামে এক কেজি। মানে হলো, এক কেজি সোনার দাম ৮৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

সোনার মান যদি ২২ ক্যারেট না হয়, তাহলে দাম আরেকটু কম হবে। বাজুস নির্ধারিত দর ২১ ক্যারেটের ক্ষেত্রে গ্রাম প্রতি ৮ হাজার ২৮৫ টাকা এবং ১৮ ক্যারেটের ক্ষেত্রে ৭ হাজার ১০০ টাকা।

গ্রামের হিসাবে যাঁরা বিভ্রান্ত, তাঁরা জেনে রাখুন ভরির হিসাব। ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রামে এক ভরি। এক কেজিতে প্রায় ৮৬ ভরি সোনা হয়। বাজারে এখন সোনার ভরি (২২ ক্যারেট) এক লাখ টাকার কিছু বেশি।

বাজুসের নির্ধারিত দর অনুযায়ী বিমানবন্দরে যে ৫৫ কেজি সোনা চুরি হয়েছে, যা যদি ২২ ক্যারেট মানের হয়, তাহলে এই সোনার দাম হবে ৪৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।
বাজুসের সহসভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিমানবন্দরে যে সোনা চুরি হচ্ছে, সেটা বার ও অলংকার। বার যদি হয়, সেটা খাঁটি সোনা হবে। মানে হলো ২৪ ক্যারেট মানের। আর বিদেশ থেকে অলংকার সাধারণত ২১ ও ২২ ক্যারেট মানের হয়।

২৪ ক্যারেট মানের সোনার দাম নির্ধারণ করে না বাজুস। বুলিয়ান বা পাইকারি বাজারে এই সোনা কেনাবেচা হয়। দাম অলংকারের দোকানের ২২ ক্যারেটের ভরির চেয়ে কম। কারণ, অলংকারের মধ্যে মজুরি, মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) ও বিক্রেতার নানান ব্যয় যুক্ত থাকে।

দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, বুলিয়ান মার্কেটে খাঁটি সোনার ভরিপ্রতি দর ৯০ হাজার টাকার আশপাশে। তাঁর হিসাব বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, চুরি যাওয়া সোনার দাম প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। অবশ্য কতটুকু সোনার বার ও কতটুকু অলংকার, সেটি আলাদাভাবে হিসাব করতে হবে।

বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগের লকার থেকে সোনা চুরির ঘটনায় গতকাল রোববার রাতে ঢাকা শুল্ক বিভাগের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। শুল্ক বিভাগ বলছে, চুরি যাওয়া সোনার দাম প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।

চুরিতে ক্ষতি কার

বিমানবন্দরে চোরাচালানের সোনা উদ্ধার হলে এবং শুল্ক দিতে না পারা সোনা জমা থাকে শুল্ক বিভাগের গুদামের লকারে। শুল্ক বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী, চুরি হওয়া সোনা ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা হয়েছিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুল্ক বিভাগের কাছে থাকা সোনার বড় অংশ চোরাচালানের, যার দাবিদার আর পাওয়া যাবে না। একাংশ বিদেশ থেকে আসার সময় নিয়ে আসা হয়েছে। এই সোনার শুল্ক পরিশোধ করে ফেরত নিতে পারবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, বিদেশ থেকে আসার সময় একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার শুল্ক-কর পরিশোধ করে আনতে পারতেন। প্রতি ভরিতে শুল্ক-কর দিতে হত দুই হাজার টাকা। সাধারণত দুটি বারেই ২৩৪ গ্রামের কাছাকাছি ওজন হয়। বিনা শুল্কে যাত্রীরা ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি পর্যন্ত সোনার গয়না আনতে পারেন।
চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে সোনা আনার ওপর কর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ভরিপ্রতি ২ হাজার টাকার জায়গায় করা হয় ৪ হাজার টাকা। সোনা আনার সুযোগও কমানো হয়েছে। সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রামের (২০ দশমিক শূন্য ৬ ভরি) এখন আনা যায় ১১৭ গ্রাম (১০ দশমিক শূন্য ৩ ভরি)।

কেউ বাড়তি সোনা আনলে তার ওপর কর চায় শুল্ক বিভাগ। না দিতে পারলে সেই সোনা রেখে দেওয়া হয়। পরে অবশ্য শুল্ক পরিশোধ নেওয়ার সুযোগ থাকে। চুরি যাওয়া সোনার মধ্যে সাধারণ মানুষের বৈধ দাবির সোনা থাকলে তা শুল্ক বিভাগকেই বুঝিয়ে দিতে হবে।
আর চোরাচালানের সোনা উদ্ধারের পর তা নিলামে বিক্রি করা হয়। টাকা জমা হয় সরকারি কোষাগারে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, আটক হওয়া সব সোনাই কিছু প্রক্রিয়া শেষে পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে। এরপর যদি ওই সোনার দাবিদার না থাকে, তখন তা নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়। আর দাবিদার থাকলে মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত নিলামের জন্য অপেক্ষা করা হয়।

নিলাম কমিটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন করে প্রতিনিধি থাকেন। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আটক সোনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে অস্থায়ী খাতে জমা থাকে। নিলাম কমিটি বিক্রির টাকা নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়।

সোনা যদি আন্তর্জাতিক মানের হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাজারদরে তা কিনে নেয়। এ ক্ষেত্রেও বিক্রির টাকা জমা করা হয় সরকারি কোষাগারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, চুরি হওয়ার ফলে ক্ষতি সরকারে। মানে জনগণের।

রিজার্ভ চুরি, কয়লা চুরি, সোনা চুরি

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়েছিল ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সেই ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি। আর কাউকে শাস্তি পেতে হয়নি। শাস্তি হয়েছে শুধু ফিলিপাইনের একজন নারী ব্যাংকারের।

সোনা চুরির বিষয়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার এ কে এম নুরুল হুদা আজাদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, আট দিন আগে গুদামটি অটোমেশনের কাজ শুরু হয়। এই কাজের অংশ হিসেবে গুদামে থাকা সোনা গণনার কাজ শুরু হয়। তাঁর ধারণা, সোনা চুরির ঘটনা আগেই ঘটেছে। গুদামের অটোমেশনের কাজ শুরু হওয়ায় সেটা ধরা পড়বে; তাই লকার ভাঙার ‘নাটক’ তৈরি করা হয়েছে।

একটু একটু করে চুরি হয়েছিল বড় পুকুরিয়া কয়লাখনির ১ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা। এই কেলেঙ্কারির মামলায় বিচার চলছে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) ছয়জন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ২২ কর্মকর্তার।

দেখা যাক, সোনা চুরির ঘটনার বিচার কোন দিকে যায়, রিজার্ভ চুরির দিকে, নাকি কয়লা চুরির দিকে।