সাইবার সহিংসতায় নারীরাই বেশি ভুক্তভোগী
দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অনলাইনে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা। গত বছর গণ-অভ্যুত্থান শুরুর সময় জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে দেশের ৮টি থানা ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে নারী ও শিশুর প্রতি সাইবার সহিংসতার ৬২০টি অভিযোগ জমা পড়ে। এসব অভিযোগ জমা পড়ে খুলনার সোনাডাঙ্গা, রংপুরের কোতোয়ালি, বরিশালের কোতোয়ালি ও কাউনিয়া, গাজীপুরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এবং ফরিদপুরের ভাঙ্গা ও কোতোয়ালি থানায়।
এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে সংবাদমাধ্যমে ৫৬টি সাইবার সহিংসতার খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ জন ভুক্তভোগীই ছিলেন নারী।
আজ বুধবার রাজধানীর ডেইলি স্টার ভবনের আজিমুর রহমান সম্মেলনকক্ষে ‘নারী ও প্রযুক্তি: অনলাইনে সহিংসতা নিরসন ও আইনি সুরক্ষায় করণীয়’ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। ১৪টি সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ (সিএসডব্লিউসি) এই সভার আয়োজন করে। এই প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।
সভায় বক্তারা বলেন, পরিবার ও সমাজে মর্যাদাহানির ভয়, সাইবার অপরাধসংক্রান্ত মামলাগুলোর প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ হওয়াসহ নানা কারণে ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগ জানাতে আগ্রহী হন না। জুলাই অভ্যুত্থানে সম্মুখসারিতে থাকা ও রাজনীতিতে অংশ নেওয়া নারীরা অনেক বেশি সাইবার সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। এই সময়ে ডিজিটাল অধিকার সুরক্ষা আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন।
বক্তারা আইনের সংস্কার, কার্যকর প্রয়োগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও নিরাপদভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি ও ঘটনার শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীকে কোনো ধরনের হয়রানি ছাড়া সেবা দেওয়ার ব্যবস্থার ওপর জোর দেন।
সভায় ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মাকসুদা আকতার বলেন, সাইবার সহিংসতার শিকার হলে কোথায় গিয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে জানেন না অনেক ভুক্তভোগী নারী। সহায়তা পাওয়ার জায়গাগুলো নিয়ে প্রচার বাড়াতে হবে। ভুক্তভোগী নারী ও শিশু ঘটনার পর অনেক মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যান, তাই প্রথমে তাঁর কাউন্সেলিং প্রয়োজন।
মাকসুদা আকতার বলেন, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা মিলে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় সেবা দিলে ভুক্তভোগী উপকৃত হবে।
সভায় সূচনা বক্তব্য দেন ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেটিকস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইআইডি) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী পরিচালক সাইদ আহমেদ। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থাকা নারীদের পরবর্তী সময়ে শুধু সরিয়ে দেওয়া হলো না, তাঁদের প্রতি অনলাইন সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সরকারকে কোনো অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। সম্প্রতি দেখা গেল, সরকার গুগলকে অনুরোধ করেছে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার কনটেন্ট সরাতে। অথচ অনলাইন সহিংসতার কনটেন্ট সরানোর কথা বলা উচিত ছিল।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর নট ফর প্রফিট ল-এর (আইসিএনএল) আইনি পরামর্শক শারমিন খান বলেন, অভিযোগ জানাতে গিয়ে ভুক্তভোগীকে যেন কোনো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়, হয়রানির মধ্যে পড়তে না হয়। সে জন্য অভিযোগ জানাতে অ্যাপের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেন অনলাইনে সহিংসতার শিকার হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অ্যাপের মাধ্যমে ভুক্তভোগী নারীরা অভিযোগ জানাতে পারেন।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ১০৯ হেল্পলাইন ইনচার্জ রাইসুল ইসলাম বলেন, এই হেল্পলাইনে প্রতিদিন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার অভিযোগ জানিয়ে কল আসে ৬ থেকে ৭ হাজার। আগের চেয়ে এখন সাইবার সহিংসতার কলের সংখ্যা বাড়ছে। অফলাইন ও অনলাইন সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধে সারা দেশে ৫ হাজার ১২৬টি কুইক রেসপন্স টিম গঠন করা হচ্ছে।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নোভা আহমেদ বলেন, অনলাইন সহিংসতা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, তা দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এসব সহিংসতার ঘটনা মুছে দিলেও কোনো না কোনোভাবে ফুটপ্রিন্ট থেকে যায়।
নোভা আহমেদ আরও বলেন, প্রযুক্তি সম্পর্কে ভয় না দেখিয়ে মেয়েদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা বাড়াতে হবে। এখন প্রযুক্তির এত দ্রুত পরিবর্তন হয় যে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আইনে বারবার সংশোধন করার ব্যবস্থা রাখা উচিত। এই প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তিবিদদের যুক্ত রাখা প্রয়োজন।
ব্লাস্টের উপপরিচালক (ভুক্তভোগী সহায়তা ও সালিস) তাপসী রাবেয়ার সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ গবেষণা কর্মকর্তা মনীষা বিশ্বাস।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রিয়া আহসান চৌধুরী ও হামিদুল মেজবাহ, ডেইলি স্টারের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক নাজীবা বাশার, ব্লাস্টের পরিচালক (পরামর্শ ও যোগাযোগ) মাহবুবা আক্তার, ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার এবং সাইবার টিনসের প্রতিষ্ঠাতা সাদাত রহমান।