‘অবিবাহিত’ সনদ পেতে কেন এত ভোগান্তি
বাংলাদেশের কোনো অবিবাহিত নাগরিক বিদেশি বিয়ে করতে চাইলে বা বিদেশে বসবাসের অনুমতির আবেদন করলে তাঁকে ‘অবিবাহিত’ সনদ দেখাতে হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে কেবিন ক্রু বা ফ্লাইট স্টুয়ার্ডেস নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতার মধ্যে একটি থাকে ‘অবিবাহিত’ হতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন চাকরি ও নানা প্রয়োজনে এই সনদ লাগে। অথচ প্রয়োজনীয় এই সনদ সহজে মেলে না। এটি সংগ্রহ করতে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, ‘অবিবাহিত’ সনদ পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থায় ঘুরতে হয় মাসের পর মাস। ‘খরচাপাতি’র কথা বলে অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘুষ আদায় করা হয়। ঘুষ না দিলে সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়। পুলিশের তদন্তের পর্যায়েও ভোগান্তি পোহাতে হয়।
সনদ পাওয়ার চেয়ে বিয়ে করা সহজ
দীর্ঘ চার বছরের পরিচয়সূত্রে বাংলাদেশের মাজেদুল নয়ন ও থাইল্যান্ডের কানালাউই ওয়ায়েক্লেহং ওরফে ‘পে’ বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। হবু স্ত্রীর আবদার ছিল, বিয়ে নিবন্ধন হবে থাইল্যান্ডের রীতিতে। ব্যাংককে বসে হবু স্ত্রী বাংলাদেশি ছেলেকে বিয়ে করতে হলে কী কী কাগজপত্র লাগবে, তা জানতে ই-মেইল করেন ঢাকায় থাই দূতাবাসে। তালিকায় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে ‘সিঙ্গেল সার্টিফিকেট’ বা অবিবাহিত সনদ লাগবে বলে জানানো হয়।
মাজেদুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশে আমি অবিবাহিত এটি প্রমাণ করা তো জটিল কোনো বিষয় নয়। তাই সনদ পাওয়ার আগে বিয়ের তারিখ ঠিক করি। কিন্তু এই সনদ পেতে আমার লেগেছে ৮০ দিন। তখন মনে হয়েছে, এ সনদ পাওয়ার চেয়ে বিয়ে করা অনেক সহজ।’
মাজেদুল যখন ‘অবিবাহিত’ সনদ নেন, তখন তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। তিনি বলেন, ২০২১ সালে করোনা সংক্রমণের কারণে থাইল্যান্ড থেকে হবু স্ত্রীর ঢাকায় আসতে খরচ হয় ৩৯ হাজার টাকা, যা সাধারণ সময়ে ছিল ১৪ হাজার টাকা। সনদ না পাওয়ায় তখন হবু স্ত্রীর ‘পর্যটক ভিসার’ মেয়াদ বাড়াতে হয়েছিল। সেই মেয়াদও শেষ হলে বিপাকে পড়তে হয়। কারণ, পর্যটক ভিসার মেয়াদ একবারই বাড়ানো যায়। তারপর সনদ পাওয়ার আগপর্যন্ত স্ত্রীকে জরিমানা দিয়ে বাংলাদেশে থাকতে হয়েছিল।
* বিদেশি নাগরিককে বিয়ে বা বিদেশে বসবাসের জন্য ‘অবিবাহিত’ সনদ লাগে। * জেলা প্রশাসন থেকে সনদ পেতে ৩ থেকে ৬ মাস লেগে যায়। * পুলিশের তদন্ত থেকে শুরু করে সনদ পেতে নানা ধাপে ঘুষ দিতে হয় বলে অভিযোগ।
মাজেদুল বলেন, ‘বৈবাহিক অবস্থা’ প্রমাণের সনদের ফরম পূরণের আগে প্রত্যয়ন জাতীয় ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু অনলাইনে আবেদন করা যায়নি। ঢাকা জেলা প্রশাসক অফিসের প্রবাসীকল্যাণ শাখায় আবেদন করতে হয়। আবেদনের আগে ব্যাংক থেকে ৭০০ টাকার চালান ও ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে ছবিসহ নোটারি করতে হয়। নোটারির সঙ্গে ব্যাংক চালান, জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন সনদসহ সব কাগজপত্র জমা দিতে হয়। তারপর শুরু হয় অপেক্ষা।
সনদ পেতে ৮০ দিন
মাজেদুল বলেন, ‘আবেদনের ১৬ দিন পর হবু স্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন। কিন্তু তখনো আমি নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করতে পারিনি। ২৩ দিন পর কাকরাইলে নগর পুলিশের বিশেষ শাখায় (সিটি এসবি) গিয়ে দায়িত্বরত ব্যক্তিকে আবেদনপত্রের স্মারক নম্বর দিই। কিছু উপরি টাকা দেওয়ার পর আবেদনপত্র সেদিনই যায় মালিবাগের এসবি অফিসে।’
মাজেদুল বলেন, এরই মধ্যে হবু স্ত্রীর বাংলাদেশে এক মাস হয়ে গেছে। ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করতে হলো। ঢাকার বাসায় এসবির তদন্ত কর্মকর্তা এলেন। সব খোঁজ নিয়ে বললেন, স্থায়ী ঠিকানায় আবার তদন্ত হবে। লক্ষ্মীপুরের বিশেষ শাখার সেই তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় আসতে লাগে আরও ২৪ দিন। এরই মধ্যে আরও কিছু কাগজপত্র জোগাড় করতে হলো।
মাজেদুল বলেন, ‘এসবি থেকে তদন্ত প্রতিবেদন গেল ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে। তারপর আরও ১০ দিন। তবে সেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা আমাকে খুব ভাগ্যবান বলে আখ্যা দিলেন।’ বললেন, ‘আপনি অল্প সময়ে সনদ পেয়েছেন।’ আমি বললাম, ‘৮০ দিন কম সময়!’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সাধারণত ৫ থেকে ৬ মাস লাগে।’
মাজেদুল আক্ষেপ করে বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশে একজন মানুষ বিবাহিত কি না, সে সনদ পেতে কেন এত ভোগান্তি হবে? জানালেন, তিনি এ নিয়ে ফেসবুকে লিখলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক ভুক্তভোগী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। অনেকেই জানান, এ সনদ নিতে কাউকে কাউকে বেশ মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষও দিতে হয়েছে।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন “অবিবাহিত” সনদের জন্য ২০ থেকে ২৫টি আবেদন আসে। বিভিন্ন দপ্তর থেকে ক্লিয়ারেন্স পাওয়ার পর পরিপত্র অনুযায়ী তা অনলাইনে পাঠিয়ে দিই। আমার কার্যালয়ে সনদ নিতে এসে কেউ ভোগান্তির শিকার হলে বা কেউ ঘুষ নিয়েছেন এমন প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ধাপে ধাপে ঘুষ ৪০ হাজার টাকা
জাপানপ্রবাসী আবির ইসলাম জাপানের নাগরিককে বিয়ের সময় দেশে থাকা স্বজনদের মাধ্যমে এ সনদ নিয়েছিলেন। তাঁর এক স্বজন সনদটি নেন। এ জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় ধাপে ধাপে যে ঘুষ দিয়েছিলেন, তার হিসাব লিখে প্রথম আলোর কাছে পাঠান আবির। তিনি বলেন, ফরিদপুর থেকে সনদটি পেতে সময় লেগেছিল তিন মাস।
আবির বলেন, সনদটি নিতে তাঁর স্বজনকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন কর্মকর্তাকে ‘খরচাপাতি’ বাবদ ৪০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছেন। তারপর দ্রুত সনদটি হাতে পেতে এক কর্মকর্তাকে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। তারপরও ওই কর্মকর্তা সন্তুষ্ট নন।
ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে, বড় বোনের হয়নি?
ইতালিপ্রবাসী এক নারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আমার অবিবাহিত সনদ পেতে বাবা তিন মাস ঘুরেছেন। স্থায়ী বসবাসের (পিআর) জন্য এ সনদ লাগে। বরিশালে আমার গ্রামে তদন্তে গিয়ে পুলিশ বলেছে, ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, বড় বোনের মানে আমার বিয়ে হয়নি, তা তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য না। গ্রামের প্রায় ৫০ জন মানুষকে ডেকে সই নিয়েছে পুলিশ। ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বলে এসেছে, আমি বিবাহিত এটা কোনোভাবে প্রমাণিত হলে সবাইকে জেলে পাঠাবেন।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কেউ বিবাহিত কি না, তার সনদ তো স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাই দিতে পারেন। এতে পুলিশের তদন্ত কেন লাগবে? প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে দায়িত্ব দেওয়ায় জটিলতা তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, টাঙ্গাইলের কোনো ব্যক্তি হয়তো রংপুরে বিয়ে করেছেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির পক্ষে তা জানার কথা নয়। এ ধরনের সনদ নিয়ে অনেক দুর্নীতি হয়। সুতরাং খোলা চোখে দেখার সুযোগ নেই, সনদ দিতে হলে বিভিন্ন সংস্থার যাচাই-বাছাই লাগবেই।