পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা পড়া যতীন্দ্র আজও নিখোঁজ, পাননি বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি

জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) যাচাই–বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করে।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হয়েছিলেন যতীন্দ্র মোহন চক্রবর্তী। এরপর তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভাষ্যমতে, পেশায় শিক্ষক যতীন্দ্র মোহন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর খবরাখবর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। তবে স্বাধীনতার এত বছর পরেও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি যতীন্দ্র মোহন। তাঁর পরিবার যেটুকু পেয়েছে, তা হলো—১৯৭২ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে দেওয়া দুই হাজার টাকার একটি চেক।

২ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছিলেন যতীন্দ্র মোহনের ছেলে তপন কুমার চক্রবর্তী। তিনি খাগড়াছড়ি জেলার একটি মন্দিরের পুরোহিত। মন্ত্রণালয়ে সবাইকে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া চেকের ফটোকপি দেখাচ্ছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিল যতীন্দ্র মোহনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একজন প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের সুপারিশপত্র।

জানতে চাইলে তপন কুমার চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৬২ সালে চাকরির উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন যতীন্দ্র মোহন চক্রবর্তী। তিনি খাগড়াছড়ির মহালছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর পাঠাতেন। নানা সহায়তাও করতেন। একপর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান যতীন্দ্র মোহন। খাগড়াছড়ির জালিয়াপাড়া-সিন্দুকছড়ির কোথাও তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল বলে ধারণা তপন কুমারের।

তপন কুমার চক্রবর্তীর ভাই গোপাল চক্রবর্তীও একজন পুরোহিত। সামান্য আয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। একই অবস্থা তপনেরও। তিনি জানান, তাঁর বাবার বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান। এ কথা জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে দুবার চিঠিও দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক ওই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর সচিব বরাবর পাঠিয়েছেন।

তপন কুমার জানান, গত ৩০ অক্টোবর খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা যতীন্দ্র মোহন চক্রবর্তীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে আধা সরকারি সুপারিশপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছেন। তপন কুমারকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবকে অনুরোধও করেছেন। এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য বীর বাহাদুর উশৈসিং ও যতীন্দ্র মোহনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করেছেন।

নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের ২৮ এপ্রিল মহালছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যতীন্দ্র মোহন চক্রবর্তী ১৯৭১ সালের এপ্রিলে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সদস্য ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলেন। এরপর তাঁর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বপন চক্রবর্তী উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়কে জানিয়েছেন, যতীন্দ্র মোহন শিক্ষিত হওয়ায় তিনি ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের লেখালেখির কাজে সহায়তা করতেন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি (স্বপন চক্রবর্তী) একসময় ভারতে চলে যান। ফিরে এসে জানতে পারেন, পাকিস্তানি বাহিনী যতীন্দ্র মোহনকে ধরে নিয়ে গেছে। এখনো তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। একই কথা বলেছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবারক আলী।

উপজেলা শিক্ষা অফিসার মইনুল ইসলামও যতীন্দ্র মোহনকে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মংমংচিং মারমার সভাপতিত্বে জেলা কমান্ডের এক বৈঠকে যতীন্দ্র মোহনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে কেন্দ্রীয় কমান্ডের কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছেন। তিনি (যতীন্দ্র মোহন) গণশহীদের মধ্যে পড়েছেন। তবুও বিষয়টি আমরা আরও যাচাই-বাছাই করে দেখব।’