আইনে থাকলেও বাস্তবে নেই পৃথক ‘শিশু আদালত’

আমাদের দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক শিশু। এই শিশুদের একটা অংশ নানা কারণে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তাই বলে শিশুদেরকে প্রচলিত আইনে যেমন–তেমন সাধারণ আদালতে বিচার করার সুযোগ নেই। শিশুদের বিচারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখতে হয়। এসব বিবেচনা থেকেই ২০১৩ সালে শিশু আইন প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১৮ সালে তা সংশোধনও করা হয়। সংশোধিত আইনে শিশুদের জন্য আলাদা আদালত বা পৃথক এজলাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখনো তেমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।

শিশু আইনে যা বলা আছে

১৮ বছরের নিচে যে কাউকে শিশু বিবেচনা করে আইনটির পঞ্চম অধ্যায়ে ‘শিশু-আদালত ও উহার কার্যপ্রণালি’ শিরোনামে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এতে ‘শিশু-আদালত’ নামে বিশেষ আদালতের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬, ১৭ ও ১৯ ধারায় এ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ধারা ১৬(১) অনুসারে আইনের সঙ্গে সংঘাত জড়িত শিশু কর্তৃক সংঘটিত যেকোনো অপরাধের বিচার করার জন্য দেশের প্রতিটি জেলা সদরে শিশু আদালত নামে এক বা একাধিক আদালত রাখতে বলা হয়েছে। অন্যথায় উপধারা (২) অনুসারে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ -এর অধীন গঠিত প্রত্যেক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু আদালত হিসেবে গণ্য হবে বলে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো জেলায় এ রকম কোনো ট্রাইব্যুনাল না থাকলে সেই জেলার জেলা ও দায়রা জজ স্বীয় অধিক্ষেত্রে উপধারা (১) এ উল্লিখিত শিশু আদালত হিসেবে গণ্য হবে বলেও আইনে বলা হয়েছে।

শিশু আদালতের অধিবেশন ও ক্ষমতা সম্পর্কে ১৭ ধারায় বলা হয়েছে। ১৭(৪) ধারা মতে, যেসব দালান বা কামরায় এবং যেসব দিবস ও সময়ে প্রচলিত আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তা ব্যতীত যতদূর সম্ভব, অন্য কোনো দালান বা কামরায়, প্রচলিত আদালতের ন্যায় কাঠগড়া ও লালসালু ঘেরা আদালত কক্ষের পরিবর্তে একটি সাধারণ কক্ষে এবং অন্য কোনো দিবস ও সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ব্যতীত শুধু শিশুর ক্ষেত্রে শিশু-আদালতের অধিবেশন অনুষ্ঠান করতে হবে।

শিশু আদালতের পরিবেশ ও সুবিধাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে ১৯ ধারায়। ১৯(১) ধারা মতে, শিশু আদালত কক্ষের ধরন, সাজসজ্জা ও আসনবিন্যাস বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে; (২) শিশু আদালতের আসনবিন্যাস এমনভাবে করতে হবে, যেন সব শিশু বিচার প্রক্রিয়ায় তার মাতাপিতা বা তাদের উভয়ের অবর্তমানে তত্ত্বাবধানকারী অভিভাবক বা কর্তৃপক্ষ বা আইনানুগ বা বৈধ অভিভাবক বা বর্ধিত পরিবারের সদস্য এবং প্রবেশন কর্মকর্তা ও আইনজীবীর, যতদূর সম্ভব, সন্নিকটে বসিতে পারে; ধারা ৩ উপবিধি (১)–এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে আদালত কক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করবে; (৪) অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, শিশু আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করতে পারবেন না।

শিশু আদালতের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে আদালতে নেই পর্যাপ্ত এজলাস। এই একটি কারণ দেখিয়ে এখনো শিশু আদালত নামে পৃথক কোনো এজলাস কক্ষ গড়ে ওঠেনি। একই এজলাসে বিচার চলছে ভাগাভাগি করে। শিশু আইনের গুরুত্বারোপ করা সত্ত্বেও অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশু কিংবা প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের বিচার চলছে একই এজলাস কক্ষে। শিশুদের জন্য আদালতের কোনো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। প্রায়ই দেখা যায়, শুনানির দিনে অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুরা তাদের অভিভাবক বা প্রবেশন কর্মকর্তার মাধ্যমে আদালতের বারান্দায় অপেক্ষা করতে থাকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে গুরুতর সব অপরাধের বিচার চলে। যেহেতু একই এজলাস ভাগাভাগি করতে হয় তাই আদালতের বাইরে সবাইকে একসঙ্গেই অপেক্ষা করে থাকতে হয়। এরপর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ডাকেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কোনো আইনের তোয়াক্কা না করেই শিশুকে কাঁঠগড়ায় তুলে দেওয়া হয়। ধারা ১৯–এর উপধারা (৪) বলছে, শিশু আদালত কর্তৃক শিশুর বিচার চলাকালে আইনজীবী, পুলিশ বা আদালতের কোনো কর্মচারী আদালত কক্ষে তাহাদের পেশাগত বা দাপ্তরিক ইউনিফরম পরিধান করতে পারবেন না। কিন্তু সে বিধান কি আদৌ মেনে চলার চেষ্টা করা হয়?

শেষ কথা

সারা দেশের আদালতগুলোয় নানা রকম অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু এরপরও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। এ ছাড়া বিচারকের সংখ্যা যেমন কম, মামলার সংখ্যা সে তুলনায় অনেক বেশি। বর্তমানে দেশে চলমান মামলার সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। এসব কারণে নিম্ন আদালতের কোনো কোনো বিচারক একই সঙ্গে দুটি আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও শিশু আদালতের বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। শিশু আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক আলোচনা আমরা শুনতে পাই। অন্য মামলার বিচার শেষে শিশু আদালতের বিচার পরিচালনা করতে হয় বিচারকদের। তাই প্রাপ্তবয়স্কদের মামলার বিচারের প্রভাব শিশুদের ওপর যেন না এসে পড়তে পারে, এ জন্য বিচারকদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। একটি সমাজের প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ পায় সেখানকার শিশুদের প্রতি আচরণের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং শিশুর সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে সবার। তাই পূর্ণাঙ্গভাবে শিশু আইন বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত।

বাহাউদ্দিন আল ইমরান আইনজীবী