বিরল সাদা শিয়ালের গল্প

অ্যালবিনো পাতিশিয়াল। ঢাকার সাভারে।ছবি: লেখক

কোভিডকালে ঘরবন্দী হয়ে পড়লেও ক্যামেরা হাতে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়তাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা ধরে। মানুষের আনাগোনায় একসময়ের মুখর ক্যাম্পাস নানা বুনো প্রাণীরা ধীরে ধীরে নিজেদের করে নেওয়া শুরু করেছিল। হল খালি, অফিস-বিভাগ বন্ধ, ক্যাম্পাসের রাস্তাঘাটে নেমে এল সুনসান নীরবতা। ফলে ওই সময় দিনের বেলায়ও অনেক নিভৃতচারী প্রাণী বেরিয়ে পড়ত খোলা প্রান্তরে, চওড়া রাস্তায়। এর মধ্যে আমাদের অতিপরিচিত পাতিশিয়াল ও বনবিড়াল ছিল অন্যতম।

একদিন বিকেলবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে গেলাম বুনো প্রাণীর খোঁজে। ক্যামেরা নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়লাম। মূল গেট দিয়ে ঢুকে পূর্ব দিকের সোজা রাস্তা ধরে চলে গেলাম কিছুটা নির্জন এলাকায়। এ এলাকায় উত্তর-দক্ষিণে একটি রাস্তা চলে গেছে পাশের ডেইরি ফার্ম থেকে উত্তর বরাবর সীমানাপ্রাচীর পর্যন্ত। রাস্তার উত্তর দিকে হাতের বাঁয়ে গবেষণা শেডে কিছু গরু। আর ডান পাশে খোলা প্রান্তর, কিছুটা ঢালু জমি। দূরে ইনস্টিটিউটের সীমানাদেয়াল, তার ওপারে ডেইরি ফার্মের গরুর জন্য সৃজিত নেপিয়ার ঘাসের সবুজ মাঠ। ফলে এ এলাকাটি নানা বুনো প্রাণীর জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা। বিশেষ করে পাতিশিয়ালের জন্য আদর্শ। দিনদুপুরে শিয়াল দলবেঁধে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়।

উত্তর-দক্ষিণে বিছিয়ে থাকা সুনসান পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছি। রাস্তার দুই পাশে এখানে–সেখানে কিছু কাঁঠালগাছ। বিকেলের রোদ তখনো বেশ আছে। আশপাশে কোনো মানুষজন নেই। আমার সামনে প্রায় এক শ মিটার দূরে রাস্তায় শুয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে এক জোড়া পাতিশিয়াল। ভাবগতি দেখে মনে হলো ওরা আমার রাস্তা ছাড়বে না। মাথা কিছুটা নোয়ানো, ভাবলেশহীন। আমি ধীর পায়ে হাঁটছি। রাস্তার ওপরের কাঁঠালগাছ থেকে বেশ কিছু হলদে পা হরিয়াল মাথার ওপর দিয়ে পূর্ব দিকে উড়ে গেল। কয়েকটি ছবি তুললাম। ডান পাশের খোলা মাঠের মাঝখানটায় মরা বাঁশের কঞ্চিতে তিনটি সবুজ সুইচোরা পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে এসে বসল। আমি পাশের খোলা মাঠে নেমে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সুইচোরার ছবি তুললাম কয়েকটা। হঠাৎ চোখে পড়ল, পূর্ব দিকের দেয়ালের কাছ থেকে বেশ বড়সড়, শিয়ালের মতো একটি প্রাণী এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কিছুটা অবাক হলাম।

আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানেই বসে পড়লাম। বিকেলের সূর্য তখনো বেশ আলো ছড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রাণীটি আমার বেশ কাছে চলে এসেছে। আকার-অবয়ব দেখে শিয়ালই মনো হলো। কিন্তু দেহ, চোখ, কান, নাক—সবই সাদা! আমি দূর্বা ঘাসে হাঁটু গেড়ে ছবি তুলছি। ওর দৃষ্টি সোজাসুজি পশ্চিম দিকে। এত কাছে এসেও আমার দিকে একটিবারের মতো ফিরেও তাকাল না। হঠাৎ আমার থেকে কয়েক গজ দূরে এসে থমকে দাঁড়াল। মনে হলো আমার ক্যামেরার শাটারের শব্দ শুনতে পেয়েছে। এরপর এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে পশ্চিমের রাস্তায় গিয়ে উঠল। অতঃপর পাশের হাঁটুসমান জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল। জীবনে প্রথম সাদা শিয়ালের দেখা পেয়ে বেশ অবাক হলাম। আবার মনের মধ্যে একটু খচখচানি শুরু হলো। সত্যিই শিয়াল দেখলাম তো, নাকি কুকুর। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম, এটি আমাদের অতিপরিচিত পাতিশিয়াল, তবে অ্যালবিনো।

মেলানিন নামের একটি বিশেষ ধরনের রঞ্জক প্রাণী দেহের রং কেমন হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে। জিনগত ত্রুটি কিংবা মেলানিন তৈরির জিনে বিচ্যুতি ঘটলে এই রঞ্জক তৈরি হয় না। এর ফলে প্রাণীর ত্বক, লোম ও চোখের রং সাদা বা গোলাপি হতে পারে। এমন প্রাণীকে বিজ্ঞানীরা অ্যালবিনো হিসেবে অভিহিত করেন। অ্যালবিনো–বৈশিষ্ট্য প্রচ্ছন্ন জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এমন প্রাণী বেশ বিরল। ফলে বুনো পরিবেশে অ্যালবিনো প্রাণী খুব কম দেখা যায়।

পাতিশিয়াল আমাদের দেশে এক অতিপরিচিত প্রাণী। এটি শিয়াল, হিয়াল, শিয়াল মামা, শিয়াল পণ্ডিত নামেও পরিচিত। গ্রামগঞ্জে পাতিশিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক গোধূলি বেলার নীরবতাকে আরও রহস্যময় করে তোলে। ফলে শিয়াল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা রকম গল্প, পৌরাণিক কাহিনি ও ভ্রান্ত ধারণা। আমাদের গল্প, কবিতায় কিংবা মননে চতুর প্রাণী হিসেবে শিয়ালের জোরালো উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

পাতিশিয়াল আকারে মাঝারি, দেহ সাড়ে তিন ফুট আর উচ্চতায় দেড় ফুট হতে পারে। পাতিশিয়াল কুকুর কিংবা নেকড়ের জাতভাই। অর্থাৎ এরা ক্যানিডি নামে একই পরিবারভুক্ত। অতীতে সারা দেশে পাতিশিয়াল দেখা গেলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা ও বিস্তার দুটিই কমছে। এরা প্রধানত মানুষের বসতির আশপাশের ঝোপঝাড়ে বাস করে। গভীর বনাঞ্চলে শিয়ালের উপস্থিতি খুব একটা নেই।

পুরুষ ও স্ত্রী শিয়াল মিলে জোড় বাঁধে। এই বন্ধন বহু বছর অটুট থাকে। নিজেদের বাচ্চাকাচ্চা মিলে চার-পাঁচটির দলে বাস করে। বেশি বয়সী শিয়াল দলের নেতৃত্ব দেয়। বাচ্চার জন্ম হলে দলের সবাই মিলে যত্ন-আত্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এরা দলে শিকার করে, খাবার খোঁজে, নিজেদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে।

পাতিশিয়াল প্রখর শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তিসম্পন্ন হয়। এই বিশেষ দক্ষতা ব্যবহার করে রাতের অন্ধকারে সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করে। পাতিশিয়াল প্রায় সব ধরনের খাবার খায়। মরা, পচাগলা প্রাণী বা তার উচ্ছিষ্ট, ফলমূল, ছোট আকারের বুনো প্রাণী প্রধান আহার। গৃহপালিত হাঁস-মুরগি চুরি করে খেতে গ্রামাঞ্চলে এদের বেশ বদনাম আছে। তবে যতটা না ক্ষতি করে, তার চেয়ে বেশি দোষী হিসেবে সাব্যস্ত হয় পাতিশিয়াল। ফসলের ক্ষতিকর ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে এদের বিশেষ ভূমিকা আছে। বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে পাতিশিয়াল গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।