বাংলাদেশের বিষয়ে আগের অবস্থানেই আছে ভারত। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু, নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, বাণিজ্য, আঞ্চলিক নিরাপত্তাসহ নানা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভারতের এমন অবস্থান উঠে এসেছে।
গতকাল শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত ব্রিফিং ছিল। সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। প্রায় ৩৫ মিনিট স্থায়ী ওই ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে ১৫টির বেশি প্রশ্ন করেন সাংবাদিকেরা।
অবশ্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশ মিশন অভিমুখে হিন্দুত্ববাদীদের বিক্ষোভ ও হামলা, বড়দিনে খ্রিষ্টানদের ওপর হামলার বিষয়ে কোনো বক্তব্য ব্রিফিংয়ে আসেনি। এমনকি ওই ব্রিফিংয়ের আগে গতকাল আসামে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের সামনে এবং পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠনের সমর্থকেরা।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ বারবার নাকচ করে আসছে সরকার। বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সংখ্যালঘু নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ না করতেও বলা হয়েছে দিল্লিকে। এসব ঘটনায় গ্রেপ্তারসহ বিভিন্ন ব্যবস্থাও নিচ্ছে সরকার।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, গত বছরের জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দুই দেশের সম্পর্ক উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভারতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি।
সংখ্যালঘু প্রসঙ্গ
বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এবং দুজন হিন্দু ব্যক্তির হত্যার ঘটনা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করা হয়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়সোয়াল বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ সংখ্যালঘুদের ওপর উগ্রবাদীদের অব্যাহত সহিংসতা ভারতের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। তিনি ময়মনসিংহে একজন হিন্দু যুবককে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
জয়সোয়াল দাবি করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৯০০টির বেশি সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যেগুলোকে কেবল ‘মিডিয়া অতিরঞ্জন’ বা ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনি বলেন, ‘সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা আমরা কীভাবে দেখি, সে বিষয়ে আমাদের অবস্থান খুবই স্পষ্ট।’
বাংলাদেশে ‘ভারতবিরোধী প্রচারণা’ এবং দুই দেশের হাইকমিশনারদের তলবের বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে জয়সোয়াল বাংলাদেশে চলমান ভারতবিরোধী প্রচারণাকে ‘মিথ্যা আখ্যান’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের।
নির্বাচন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি
বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে জানতে চাইলে জয়সোয়াল বলেন, ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে আমাদের অবস্থান শুরু থেকেই খুবই স্পষ্ট এবং এ অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করার পক্ষে ভারত।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার পক্ষে এবং নির্বাচন নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও আপনি জানেন। আমরা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে, যা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এটাই আমাদের অবস্থান। আমরা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষেই আছি।’
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে যদি অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগকে (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) বাদ দেয়, তবে ভারত সেই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে জয়সোয়াল বলেন, ভারত এমন একটি নির্বাচন চায়, যা অবাধ, সুষ্ঠু হবে এবং যেখানে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
২০১৮ সাল থেকে লন্ডনে বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগের খবর এবং বিএনপি নেতার বাংলাদেশে ফেরার আগে ভারতের ক্লিয়ারেন্সের (ছাড়) আলোচনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন এক সাংবাদিক। এ বিষয়ে জয়সোয়াল বলেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে সমর্থন করে ভারত। বিএনপি নেতার লন্ডন থেকে ফেরাকে সেই প্রেক্ষাপট থেকে দেখা উচিত।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে ভারত ছিল তাঁর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র। নয়াদিল্লির সমর্থন আওয়ামী লীগকে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের বৈতরণি পেরোতে সহায়তা করেছিল।
শেখ হাসিনাকে ফেরত প্রসঙ্গ
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনাকে গত ১৭ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের আগে–পরে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী হস্তান্তরের জন্য ভারতকে একাধিকবার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ; কিন্তু ভারত এতে সাড়া দেয়নি।
গতকাল এ বিষয়ে ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করা হয়। পাশাপাশি ভারত থেকে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ নেতারা বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছেন কি না—এমন অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে রণধীর জয়সোয়াল শুধু প্রত্যর্পণের বিষয়টিতে উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ভারত সাধারণত আইনের দৃষ্টিতে পলাতক ব্যক্তিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে এ ধরনের প্রক্রিয়ায় অনেক আইনি ধাপ বা জটিলতা জড়িত থাকে। বাংলাদেশের অনুরোধের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জয়সোয়ালের মন্তব্য ছিল, ‘বিষয়টি যে পর্যায়ে ছিল, সেখানেই আছে।’
আঞ্চলিক নিরাপত্তা
ভারতের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ভারতের জন্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারতের পরিকল্পনা কী, তা জানতে চাওয়া হয়। বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি এবং পাকিস্তানি নৌবাহিনী প্রধানের সফর নিয়েও প্রশ্ন করা হয়।
জয়সোয়াল বলেন, ভারত এ ধরনের সব ঘটনা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব এবং দুই দেশের হাইকমিশনারদের পাল্টাপাল্টি তলব করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ব্রিফিংয়ে। জয়সোয়াল বিষয়টিকে ‘মিথ্যা আখ্যান’ হিসেবে উল্লেখ করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সে দেশের সরকারের।
বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে ভারতের বিনিয়োগ এবং ঋণচুক্তি (লাইন অব ক্রেডিট–এলওসি) বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। এ ছাড়া সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে ভারত আর্থিক সহায়তা বা নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনা করছে কি না, তা–ও জানতে চাওয়া হয়।
জয়সোয়াল বলেন, বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর ও বন্ধুত্বের, যা মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হলেও ভারত উন্নয়ন সহযোগিতা ও আর্থিক সম্পর্কের বিষয়ে ইতিবাচক থাকতে চায় এবং বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দেয়।
গণমাধ্যমের ওপর হামলা
ঢাকায় অবস্থিত প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার–এর মতো প্রধান সংবাদপত্র অফিসগুলোতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়ে ভারতের কোনো মন্তব্য আছে কি না, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। পাশাপাশি জয়সোয়ালকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, গতকাল প্রথম আলো একটি সম্পাদকীয় ছেপেছে। এতে বলা হয়েছে, ভারত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অন্য শীর্ষ নেতাদের ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাতে দিচ্ছে। এ বিষয়ে তাঁর (জয়সোয়াল) কোনো মন্তব্য আছে কি না? তবে জয়সোয়াল এ দুটি প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন।
জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান সংকটের মূল কারণ হচ্ছে, চব্বিশের বিপ্লবকে ভারত মেনে নিতে পারেনি। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বড় বাঁকপরিবর্তন। কাজেই সম্পর্কের ভবিষ্যতের স্বার্থেই এই পরিবর্তন মেনে নিতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের একে অন্যের ভালো প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে হবে। যার লক্ষ্যই হবে দুই দেশের মানুষের কল্যাণ। তাই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যে বিষয়গুলো আছে, তার সবগুলোকেই বিবেচনায় নিতে হবে।’