অন্য সবার চেয়ে জিল হোসেনের জীবনের গল্পটা ভিন্ন। তাঁর ৭২ বছরের জীবনের ৪৭ বছরই কেটেছে আইনি লড়াইয়ে। প্রথমে পরীক্ষা পাসের সনদ পেতে এবং পরে ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তবে ক্ষতিপূরণ মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই তাঁর জীবনের ইতি ঘটে।
পরিবারের তথ্য অনুযায়ী, জিল হোসেনের জন্ম ১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি। ১৯৭৩ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি স্নাতক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। স্নাতক পাসের পর তাঁর বন্ধু-সহপাঠীরা যখন একে একে চাকরিতে ঢুকেছেন, তখন তাঁকে আইনি লড়াইয়ে যেতে হয়েছে সেই সনদ পেতে। আদালতের রায়ের পর ৪৭ বছর বয়সে তাঁর হাতে পরীক্ষা পাসের সনদ আসে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের ওই ঘটনার পর তিনি আর কোনো চাকরিতে ঢোকার সুযোগ পাননি। সিরাজগঞ্জ সদরের চিলগাছা গ্রামে পরিবার নিয়ে থাকতেন জিল হোসেন। ছোটখাটো ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। তাঁর চার ছেলে, চার মেয়ে। চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি জিল হোসেন মারা যান।
আইনি লড়াইয়ের শুরু
১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষে জিল হোসেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি (অ্যাগ্রি) স্নাতক দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ বর্ষের পুরাতন পাঠ্যক্রমের চূড়ান্ত পরীক্ষার্থী ছিলেন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফলাফলে জিল হোসেনকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এই ফলাফল পুনর্বিবেচনা চেয়ে একাডেমিক কাউন্সিলে আবেদন করে বিফল হন তিনি। পরে ১৯৭৫ সালে তিনি আবার পরীক্ষায় অংশ নেন, কিন্তু তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। এসবের প্রতিকার চেয়ে ১৯৭৫ সালের ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের প্রথম মুনসেফ আদালতে তিনি মামলা করেন। মামলায় তিনি দাবি করেছিলেন, তাঁর প্রাপ্ত নম্বরের (১৯৭৩ সালে দেওয়া পরীক্ষায়) সঙ্গে ভগ্নাংশ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নম্বরের সঙ্গে ভগ্নাংশ যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য ঘোষণা করে। এই মামলায় আদালত ১৯৭৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে ভগ্নাংশ নম্বর যোগ না করে তাঁকে অকৃতকার্য করাকেও বেআইনি ঘোষণা করা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে জজ আদালতে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৬ সালের ৩১ জানুয়ারি এই আদালতের দেওয়া রায়ে জিল হোসেনকে বহিষ্কার আদেশ বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একই বছর হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট মামলাটি পুনঃ বিচারের জন্য প্রথম মুনসেফ আদালতে পাঠান। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রথম মুনসেফ আদালত ভগ্নাংশ নম্বর যোগ করে ৩০ দিনের মধ্যে জিল হোসেনের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার জেলা জজ আদালতে আপিল করে, যা নামঞ্জুর হয়। পরে হাইকোর্টে আপিল করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর ওপর ১৯৮৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেওয়া হয়। এই রায়ে বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল থাকে।
অতঃপর সনদ ও ক্ষতিপূরণ মামলা
পরিবার ও মামলাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর জিল হোসেনের একটি আবেদন গ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পরে তাঁকে পাস নম্বর দিয়ে ১৯৯৭ সালের ২২ অক্টোবর নম্বরপত্রের সনদ দেয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তখন তাঁর বয়স ৪৭ বছর অর্থাৎ সরকারি চাকরির বয়সসীমা শেষ। এরপর ২০০০ সালের ১৮ অক্টোবর ক্ষতিপূরণ দাবি করে অধস্তন আদালতে মামলা করেন জিল হোসেন। এতে দাবি করা হয়, হাইকোর্টের রায় ১৪ বছর ৯ মাস পরে কার্যকর করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কাজে তাঁর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, ক্ষতিপূরণ মামলায় ২০০৮ সালের ২৬ আগস্ট রায় দেন ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। রায়ে ৩০ দিনের মধ্যে ২ কোটি টাকা জিল হোসেনকে দিতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এর বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এ-সংক্রান্ত আপিল এখন বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী ও বিচারপতি মো. আলী রেজার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি ও নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
১৩ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি আপিল
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা দেওয়ানি আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ৪ জুন হাইকোর্ট শর্তসাপেক্ষে ময়মনসিংহের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতের ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান-সংক্রান্ত আদেশ স্থগিত করেন। শর্তে ২ কোটি টাকার সাড়ে ১২ পারসেন্ট অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা তিন মাসের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়ে যাবে বলে ওই আদেশে উল্লেখ করা হয়।
জিল হোসেনের পক্ষে হাইকোর্টে এই মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির পক্ষ থেকে আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাসকে নিয়োগ দেওয়া হয়। দুই কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রায়ের বিরুদ্ধে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের করা আপিল গত ১৩ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি জানিয়ে আইনজীবী চঞ্চল কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের মামলায় আপিলকারীপক্ষের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আইনজীবীর বারবার সময়ের আরজি ও অনুপস্থিতির কারণে আপিল নিষ্পত্তি হয়নি। জিল হোসেন মারা যাওয়ার পর আপিল শুনানির জন্য উঠলে ১৩ বছর আগে হাইকোর্ট ২ কোটি টাকার সাড়ে ১২ পারসেন্ট টাকা সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তা সামনে আসে। এ অবস্থায় হাইকোর্ট আপিলকারী পক্ষকে ভর্ৎসনা করে ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়ে আসতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই অর্থ জমা দেয়।’ মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে এই আইনজীবী বলেন, আগামী বছরের জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে হাইকোর্টে আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
অবশ্য এ বিষয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. ছাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের করা আপিল শুনানির জন্য উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে আইনজীবী শুনানিতে ছিলেন। নিয়ম মেনে প্রক্রিয়া অনুসারে সাড়ে ১২ পারসেন্ট হারে টাকা ইতিমধ্যে প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
জিল হোসেনের ছোট ছেলে নূর মোহাম্মদ সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে চলতি বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১০ সালে বাবা স্ট্রোক করেন। দুই বছর পর আবার স্ট্রোক হয় তাঁর। এর পর থেকে খুব বেশি হাঁটাচলা করতে পারতেন না, কথাও স্পষ্টভাবে বলতে পারতেন না। মামলা চালাতে গিয়ে জমিজমা যা ছিল, তার প্রায় সবই বিক্রি করে দিয়েছেন বাবা। তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল মামলার রায় দেখে যাওয়া, তবে তা পূরণ হয়নি। মামলাটি যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, তা আশা করি।’