কাছের মানুষ যখন ‘ডিজিটাল দানব’

ঘটনা-১

আট বছর আগে ফারিয়া তাহসিন (ছদ্মনাম) আর জুবায়ের হাসান (ছদ্মনাম) রাজধানীর একটি বেশ নামীদামি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তেন। প্রথমে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও পরে তা প্রেমে পরিণত হয়। তিন বছর আগে উচ্চশিক্ষার জন্য জুবায়ের কানাডায় চলে যান। তবে তাঁদের মধ্যে অনলাইনে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। দুজন ভিডিও কলেও কথা বলতেন। সেই সময় ফারিয়ার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে রাখেন জুবায়ের। মেয়েটি একসময় প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এরপর জুবায়ের ক্ষিপ্ত হয়ে ফারিয়ার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সেসব ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। এমনকি পর্ন সাইটেও মেয়েটির সেসব ভিডিও আপলোড করা হয়। একসময়কার বন্ধু ও প্রেমিকের এমন ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ফারিয়া মামলা করতে বাধ্য হন।

ঘটনা-২

রাজধানীতে বসবাসকারী ৩৮ বছর বয়সী গৃহবধূ আঁখি (ছদ্মনাম)। তাঁর স্বামী থাকেন কাতারে। স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় তিনি একাকিত্ব অনুভব করতেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসমাইল হোসেনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তাঁরা নিয়মিত ফোনে কথা বলতেন। একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আঁখি ও ইসমাইল ভার্চ্যুয়ালি অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতেন। ইসমাইল অন্তরঙ্গ মুহূর্তের সেসব ভিডিও করেন। একসময় তিনি আঁখিকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেন। আঁখি যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে ইসমাইল কিছু ভিডিও অনলাইনে প্রকাশ করে দেন। ইসমাইলকে আসামি করে মিরপুর থানায় মামলা করেছেন আঁখি।

ঘটনা-৩

অনিন্দিতার (ছদ্মনাম) বয়স ৩০ বছর। বসবাস করেন ঢাকায়। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিন বছর আগে আরিফের (ছদ্মনাম) সঙ্গে ফেসবুকে তাঁর পরিচয় হয়। পরে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৯ সাল তাঁরা বিয়েও করেন। আরিফ গোপনে তাঁদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করেছিলেন। একসময় তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি হয়। অনিন্দিতা সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত জানালে আরিফ ভুয়া ফেসবুক আইডি থেকে সেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও ছেড়ে দেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অনিন্দিতা আদালতে মামলা করেন।

নব্বইয়ের দশকেও মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল কাগজের চিঠি। তবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বদলে দিয়েছে মানুষের যোগাযোগের মাধ্যমসহ আরও অনেক কিছু। হাতে লেখা চিঠির জায়গা দখল করে নিয়েছে ভার্চ্যুয়াল নানা মাধ্যম। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটি ছাড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এখন মানুষের নিত্যসঙ্গী। বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের যত ঘটনা, তার অন্যতম মাধ্যমই হচ্ছে এই মুঠোফোন, ফেসবুক, ইমো, গোপন ক্যামেরাসহ অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তি।

ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাইবার ট্রাইব্যুনালে যত মামলা বিচারের জন্য এসেছে কিংবা যত মামলা ট্রাইব্যুনালে দায়ের হয়েছে, তার বড় অংশ হচ্ছে নারীর আপত্তিকর ছবি কিংবা ভিডিও ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়া ঘটনায়। বেশির ভাগ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ভুক্তভোগীদের পরিচিত ও একসময়ের কাছের মানুষ।

নারীদের আপত্তিকর ছবি কিংবা ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার অন্তত ৫০টি মামলার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিবাহিত নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও গোপনে রেকর্ড করেছেন তাঁর স্বামী। নানাবিধ কারণ যখন তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়, তখন স্বামী নারীর সেসব ছবি বা ভিডিও ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেন এবং গোপনে সেসব দৃশ্য রেকর্ড করার তথ্য ভুক্তভোগী নারীকে জানিয়ে দেন। যোগাযোগ যখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তখন সেসব দৃশ্য নারীর পরিচিতজনদের কাছে ইমো কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হয়। পরে তা ভুয়া ফেসবুক আইডি কিংবা পর্ন সাইটে নারীর ভিডিওগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বিবাহিত নারীর বাইরে যেসব ভুক্তভোগী নারী আছেন, তাঁরা পরিচিত বন্ধু, প্রেমিক কিংবা সহপাঠীর জিঘাংসার শিকার। পরিচয় থেকে প্রেম, পরে বিয়ের প্রলোভনের ফাঁদ, এরপর ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ভিডিও গোপনে ধারণ করা হয়। প্রেমিক কিংবা কাছের মানুষের নানাবিধ আচরণে যখন কোনো নারী সম্পর্ক ছিন্ন করে বা করার চেষ্টা করে, তখন ওই ব্যক্তির প্রকৃত চেহারা ফুটে ওঠে। গোপনে ধারণা করা ভিডিও পাঠিয়ে দিয়ে হুমকি দেন। কাছের মানুষ স্বার্থের দ্বন্দ্ব কিংবা অন্য কোনো কারণে একসময় শত্রু হয়ে ওঠেন। তাই সম্পর্কে জড়ানোর আগে-পরে এসব বিষয় মাথায় রাখা জরুরি।

সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ও আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময়ের কাছের মানুষদের দ্বারা বহু নারী বিপদে পড়েছেন। ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হচ্ছেন। কাছের মানুষ দূরে সরে গেলে মুঠোফোন, মেসেঞ্জার, ইমো কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের আলাপন ‘ডিজিটাল অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার কতটা ভয়ংকর হতে পারে, যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তাই বিপদে পড়তে না চাইলে প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত। আর কেউ যদি ভুক্তভোগী হন, দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। তাতে সাইবার অপরাধী আইনের আওতায় আসবেন, হবেন বিচারের মুখোমুখি।