জাপানি দুই শিশু: ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি বিবেচনায় মেজ মেয়েটি বাবার কাছে থাকবে

মা ও বাবার সঙ্গে জাপানি দুই শিশুপ্রথম আলো ফাইল ছবি

ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত মেজ মেয়েটি তার বাবা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফের হেফাজতে থাকবে। তবে তার বড় বোন মা জাপানি নাগরিক নাকানো এরিকোর হেফাজতে থাকবে।

শিশুদের বাবার করা এক আবেদনের (সিভিল রিভিশন) ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এ সিদ্ধান্ত এসেছে। বিচারপতি মামনুন রহমানের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ওই রায় দেন। ৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদালত বলেছেন, উভয় পক্ষেরই (শিশুদের বাবা ও মা) সন্তানদের দেখার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দুই সন্তানের সঙ্গে মা–বাবা দেখা করতে পারবেন। আর এটি করতে ইমরান শরীফ এবং নাকানো এরিকো একে অপরকে অনুমতি দেওয়া দায়িত্ব।

শিশুদের হেফাজত নিয়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিশুদের বাবার করা পারিবারিক আপিল নামঞ্জুর করে গত বছরের ১২ জুলাই রায় দেন ঢাকার জেলা জজ আদালত। এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট আবেদন (সিভিল রিভিশন) করেন তাদের বাবা। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ২৩ জুলাই হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। রুল আংশিক চূড়ান্ত ঘোষণা করে ওই রায় দেওয়া হয়।

বিচারিক আদালতের রায় থেকে উদ্ধৃত করে পূর্ণাঙ্গ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, বড় মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে এবং মেজ মেয়ে তার বাবার কাছে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেছে। শুনানির সময় এই কোর্ট (হাইকোর্ট) দুই মেয়ের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেন এবং তারা একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। মেজ মেয়ে সুস্পষ্টভাবে বলেছে, সে কোনো অবস্থাতেই তার বাবাকে ছেড়ে যাবে না।

পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরও বলা হয়, মেজ মেয়ে আদালতকে জানিয়েছে, বাবা তার প্রতি যত্নশীল এবং পুরোপুরি মনোযোগী। ভবিষ্যতের জন্য একসঙ্গে থাকার গুরুত্ব বিবেচনায় এক শিশু থেকে অপর শিশুকে সহোদরা হওয়ার কারণে আলাদা করা কঠিন। শিশুর মানসিক অবস্থা ও অভিপ্রায়সহ অন্যান্য সব দিক বিবেচনায় নিয়ে হেফাজতে দেওয়া হয়। মেজ মেয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সে তার বাবার সঙ্গে থাকতে অনড়।

আদালতে ইমরান শরীফের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আখতার ইমাম, রাশনা ইমাম ও নাসিমা আক্তার লাভলী। এরিকোর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি, আহসানুল করিম ও মোহাম্মদ শিশির মনির।

পূর্ণাঙ্গ রায় গত বৃহস্পতিবার হাতে পেয়েছেন বলে জানান শিশুদের মায়ের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আজ সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‌দুই শিশু মায়ের কাছে ছিল। বিচারিক আদালতে মামলা চলার সময় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিমানবন্দর থেকে মেজ মেয়েটি তার বাবার কাছে চলে যায়। এর পর থেকে সে তার বাবার কাছেই আছে। তিন শিশুর মধ্যে বড় মেয়েটি মায়ের কাছে আছে। ছোট সন্তান শুরু থেকে জাপানে নানির কাছে রয়েছে। মেজ সন্তানের সঙ্গে তার মায়ের দেখাসাক্ষাৎ করার অধিকার থাকবে এবং বড় সন্তানের সঙ্গে তাদের বাবারও দেখাসাক্ষাৎ করার অধিকার থাকবে বলে রায়ে এসেছে। মেজ সন্তান বাবার কাছে থাকবে—এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আগামী ২২ এপ্রিল শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

ঘটনার পূর্বাপর

আইনজীবীদের তথ্য অনুসারে, জাপানের নাগরিক নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ইমরান শরীফের ২০০৮ সালের ১২ জুলাই বিয়ে হয়। তাঁদের তিন মেয়েসন্তান। বড় মেয়ের জন্ম ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, মেজ মেয়ের জন্ম ২০১১ সালের ১২ অক্টোবর ও ছোটটির জন্ম ২০১৪ সালের ২৫ জুন। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরানের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য এরিকো আবেদন করেন। ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে (বড় ও মেজ) নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ছোট মেয়েকে জাপানে মায়ের কাছে রেখে ২০২১ সালের ১৮ জুলাই এরিকো বাংলাদেশে আসেন। ঢাকায় এসে দুই সন্তানকে ফিরে পেতে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট রিট করেন এরিকো। অন্যদিকে ছোট মেয়েকে ফিরে পেতে আরেকটি রিট করেন ইমরান।

আরও পড়ুন

এরিকো ও ইমরানের পৃথক রিটের ওপর শুনানি নিয়ে দুই শিশু তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে থাকবে বলে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দেন। শিশুদের মা এরিকো তাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন শিশুদের মা। পরে ২০২২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ আদেশ দেন। আদেশে ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটির (শিশুদের বাবার করা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। শিশুদের বাবা ইমরান তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন বলে উল্লেখ করা হয়।  

দুই শিশুর হেফাজত চেয়ে পারিবারিক আদালতে বাবার করা মামলা খারিজ করে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ঢাকা জেলা জজ আদালতে পারিবারিক আপিল করেন ইমরান শরীফ। এই আপিল নামঞ্জুর করে ও পারিবারিক আদালতের দেওয়া সিদ্ধান্ত বহাল রেখে গত ১২ জুলাই রায় দেন ঢাকার সিনিয়র জেলা জজ। এই রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই হাইকোর্টে আবেদনটি করেন ইমরান শরীফ।