স্মৃতির আলপনায় আঁকা

ফরিদপুরের অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুরে পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের সেই ঘর
ছবি: আলীমুজ্জামান

জুনের শেষে এবার খুব বৃষ্টি হলো। ঈদুল আজহার পরের দিন জবজবে হয়ে গেল রাঙা ছোটুর কবর। চারপাশ থেকে তখন উঠে আসছে ভেজা পাতা মাখানো মাটির গন্ধ। রাঙা ছোটুর কবরের কাছেই শুয়ে আছে তাঁর সন্তান। তরুণ বয়সে যে লিখেছিল, ‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে/ তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’ মা আর ছেলের কবরের কাছে লেখা আছে ‘কবর’ কবিতার প্রথম দুই চরণ।

ফরিদপুর শহরের অম্বিকাপুরের গোবিন্দপুরে পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের বাড়িতে প্রবেশের আগে কয়েকবার দেখা হবে কুমার নদের সঙ্গে। ভরা বর্ষায় সে এখনো নিজের শক্তি দেখাতে চায় কবির বাড়ির কাছে। একসময় মূল পদ্মাই ছিল। বাড়ির ওপাশে নতুন জমির চর আদমপুরে পৌঁছে যাওয়া যায় এক দীর্ঘ বাঁশের সাঁকো দিয়ে।

অনেক তালগাছ আর বাবুই পাখির বাসা আছে চর আদমপুরে। এপাশে দাঁড়ালে পর্যটকের স্মৃতিতে উঠে আসতে পারে স্কুলপাঠ্যের কয়েক পঙ্‌ক্তি, ‘ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী/ পারের খবর টানাটানি করি/ বিনাসুতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া।’

পল্লি সাহিত্যের সঙ্গে শহুরে পাঠকের সম্পর্ক তৈরির কাজটি এমন বিনাসুতি মালাতেই গেঁথেছিলেন জসীমউদ্‌দীন। তাঁর বাড়িটি শুধু নান্দনিকই নয়, বহু যুগের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসও বটে।

১৯২৫ সালে বাংলার অল বেঙ্গল কংগ্রেসসহ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হয়েছিল ফরিদপুর শহরে। রাজনৈতিক সভা করতে ফরিদপুরে এসে একজন স্বেচ্ছাসেবকের বাড়িতে উঠেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সে যুবকের অনুরোধে এই নদীর পাড়ে বাঁশতলায় বসে লিখেছিলেন, ‘আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ/ নদীর তীরে ডিঙি তরী পথিক ধরা ফাঁদ।’ পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের লেখা যাঁদের দেখেছি বইয়ে পাওয়া যাবে এসব গল্প। তখন কেউই জানে না, তাঁদেরই একজন হবেন আমাদের জাতীয় কবি, অপরজন পল্লিকবি।

গোবিন্দপুরের এই বাড়িতে এখন থাকেন কবিপুত্র জামাল আনোয়ার। প্রথম আলোকে জানালেন, ‘বাড়ির বড় বড় গাছগুলো আমার মা–বাবার হাতে লাগানো। পদ্মা আরও কাছে ছিল আগে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এসেছেন এ বাড়িতে। এখন দর্শক আসে, টিকিট কেটে প্রবেশ করে। ভালো লাগে তাদের চোখে মায়া দেখে।’

এ বাড়ি এক মায়ারই জগৎ। কবি আর তাঁর পিতা, পুত্র, ভাইয়ের ঘর। ঢেঁকি, কাঠে বাঁধানো সাবেকি আয়না, মাটির মটকা, অনেক রকম পুতুল, কবির ব্যবহার করা টেলিফোন, বইপত্র আর আছে অসংখ্য ছবি আর কবিতার ছত্র। টুকরা টুকরা আলপনার নকশা সাজিয়ে রেখেছে গাঢ় সবুজ বাড়িটিকে। কবির ঘরের দরজার ওপর একটা তথ্য আছে গয়না চুরির। ১৯৩৯ সালে মমতাজ বেগম আর কবির বাসরঘরে চোর ঢুকেছিল।

সেদিন চুরি হয়েছিল এক কিশোরী বউয়ের বিয়ের সব গয়না। টিনে লাল রঙের পরত দিয়ে সাদা কালিতে লেখা আছে সে গল্প। আরেক পাশে এক চমৎকার শুভাশীষ। জসীমউদ্‌দীনের বিয়ের সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। চিঠির প্রতিলিপি করা হয়েছে বড় আকৃতিতে। জানালা দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে দুলছে দড়ির শিকা আর ওর উদরে মাটির হাঁড়ি।

কয়েক বছর আগে কবির বাড়ির পেছনের ফসলের মাঠে তৈরি হয়েছে ‘পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন জাদুঘর ও লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র’। সেখানকার সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রেশন অফিসার মো. জাফর আলী মিয়া জানালেন, ‘শুক্রবার ভিড় বাড়ে। দিনে ৫০ থেকে ৮০ জন দর্শক আসেন। কমপ্লেক্স আর বাড়িতে প্রবেশের টিকিট আলাদা।’

নতুন কমপ্লেক্সে আছে কবির ব্যবহার করা অনেক জিনিসের সমারোহ। একসময় বাড়ির পেছনের ছোট টিনের গেট দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যেত এখানে। গোবিন্দপুরের এই পুরো অঞ্চলই জসীমউদ্‌দীনের স্মৃতিচিহ্ন। প্রতিবছর জসীম পল্লি মেলার আয়োজন হচ্ছে নব্বইয়ের দশক থেকে।

পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের বাড়িতে আসার পথে প্রথমে চোখে পড়বে সোজন বাদিয়ার ঘাট, এরপর গোবিন্দপুর মহাশ্মশান। শোনা যায়, স্কুল পালিয়ে কবি এই শ্মশানে এসে সাধুদের সঙ্গে বসে থাকতেন। ঘুরতেন খালি পায়ে। ছোট্ট জসীমউদ্‌দীনকে কেউ কেউ সাধু বলেই ডাকতেন। খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনও বলতেন, ‘আমাদের সাধুদা।’ জসীমউদ্‌দীনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত এক বিশেষ সংখ্যায় পাওয়া যাবে মৃণাল সেনের স্মৃতিচারণা।

তবে তাঁর বাড়িটিই গ্রামবাংলার এক উৎকৃষ্ট স্মৃতির আকর, যেখানে সবার নিমন্ত্রণ দিয়েই রেখেছেন কবি। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সেখানে লেখা আছে, ‘তুমি যাবে ভাই - যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়’।