মেট্রোরেলের স্থায়ী কার্ডের সংকট কাটবে কবে

মেট্রোরেলের টিকিট কাটতে লম্বা লাইন। ঢাকা, ১৩ এপ্রিলছবি: প্রথম আলো

এক মাস ধরে মেট্রোরেলের একটি স্থায়ী কার্ড কেনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ঢাকার দক্ষিণখানের বাসিন্দা হেলেনা জাহিদ। উত্তরা উত্তর স্টেশনে কয়েকবার গিয়েও বিফল হয়ে ফিরতে হয়েছে। শেষে হালই ছেড় দিয়েছেন তিনি।

প্রায়ই গোপীবাগে যেতে হয় হেলেনা জাহিদকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উত্তরা থেকে মেট্রোরেলে খুব সহজে মতিঝিল নেমে গোপীবাগে যাওয়া যায়। স্থায়ী কার্ড না থাকায় এখন একক যাত্রার কার্ড দিয়ে যাতায়াত করেন। এ জন্য প্রতিবারই লাইনে দাঁড়িয়ে কার্ড কিনতে হয়। এতে সময়ও বেশি লাগে, খরচও বাড়ে।

ঢাকায় হেলেনার মতো অনেকেই এখন এমন সমস্যায় রয়েছেন। নিয়মিত যাতায়াতের জন্য স্থায়ী কার্ড করতে চাইলেও পাচ্ছেন না। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা এই সংকট সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বললেও তাতেও সংকট মোচনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।

২০২২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয়। প্রথমে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলত এই বৈদ্যুতিক ট্রেন। এখন মতিঝিল পর্যন্ত চলছে। কমলাপুর পর্যন্ত লাইন সম্প্রসারণের কাজও চলছে। মেট্রোরেলে এখন প্রতিদিন গড়ে চার লাখ যাত্রী যাতায়াত করেন।

ডিএমটিসিএল–ডিটিসিএর টানাটানিতে নতুন করে কোনো এমআরটি পাস কেনা হয়নি। অন্যদিকে ডিটিসিএ যে সংখ্যক র‍্যাপিড পাস কিনছে, তা দিয়ে গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।

মেট্রোরেলে যাতায়াতের জন্য স্থায়ী কার্ড আছে দুটি—র‍্যাপিড পাস ও এমআরটি পাস। এমআরটি পাসের মালিক মেট্রোরেল পরিচালনাকারী ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। র‍্যাপিড পাসের মালিক ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। দুটি প্রতিষ্ঠানই সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন। এক মন্ত্রণালয়ের অধীন হলেও স্থায়ী কার্ড কেনা এবং নিয়ন্ত্রণ কোন প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকবে, এ নিয়ে টানাটানি চলেছে গত এক বছর।

এর ফলে নতুন করে কোনো এমআরটি পাস কেনা হয়নি। এই কার্ড আর বিক্রি হচ্ছে না। অন্যদিকে ডিটিসিএ যে পরিমাণ র‍্যাপিড পাস কিনছে, তা দিয়ে গ্রাহকের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। সে কারণেই যাত্রীদের এই ভোগান্তি।

মেট্টোরেল
ফাইল ছবি

উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলাচলকারী মেট্রোরেলের লাইন-৬ প্রকল্পের অধীনে শুরুতে ৭ লাখ ২৩ হাজার এমআরটি কার্ড কিনেছিল ডিএমটিসিএল। একক যাত্রার কার্ড কেনা হয়েছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার। যাত্রী বেড়ে যাওয়ার পর ডিএমটিসিএল ৪ লাখ ৪০ হাজার একক যাত্রার কার্ড কেনে। এখনো আড়াই লাখের মতো একক যাত্রার কার্ড রয়েছে। অর্থাৎ একক যাত্রার কার্ড যাত্রীদের চাহিদা মতো বিক্রি করা যাচ্ছে। তবে এমআরটি পাস গত বছর ফুরিয়ে যাওয়ার পর আর কেনা হয়নি।

ডিটিসিএ র‍্যাপিড পাস ৫০ হাজার দিয়েছে, আরও দেবে। এর বাইরে এক লাখ এমআরটি কার্ড কিনতে শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করা হবে
ফারুক আহমেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিএমটিসিএল

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে মেট্রোরেলের স্থায়ী কার্ড কেনার দায়িত্বটি ডিটিসিএর কাছে দেওয়া হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, স্থায়ী কার্ডটি এমন হবে যে একটি কার্ড দিয়েই রাজধানীর মেট্রোরেল, বাস ও ট্রেনসহ সব ধরনের গণপরিবহনে যাতায়াত করা যাবে। এমনকি সেতু কিংবা পার্কিংয়ের টোলও পরিশোধ করা যাবে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকা। পরিকল্পনাটি ছিল, একটি ক্লিয়ারিং হাউস থাকবে। আর এটি পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র কোম্পানি হবে। ক্লিয়ারিং হাউস হয়েছে। তবে কোম্পানিটি আর হয়নি।

ডিটিসিএ সূত্র জানায়, শুরুতে ক্লিয়ারিং হাউস পরিচালনা করত জাইকার একটি কারিগরি দল। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর তারা চলে যায়। এখন ক্লিয়ারিং হাউসটি পরিচালনা করছে ডিটিসিএ। এই ক্লিয়ারিং হাউস ব্যবহার করার জন্য মেট্রোরেলের স্থায়ী কার্ডে যাতায়াতকারী প্রতে৵ক যাত্রীর ভাড়ার ৩ শতাংশ পাচ্ছে ডিটিসিএ।

দেশে এ পর্যন্ত মেট্রোরেল ছাড়া অন্য কোনো গণপরিবহনে র‍্যাপিড পাস পুরোপুরি কার্যকর নেই। ফলে এই কার্ডের মূল চাহিদা মেট্রোরেলেই সীমাবদ্ধ। মেট্রোরেল চালুর পর ডিটিসিএ তিন দফায় সাড়ে ছয় লাখের মতো র‍্যাপিড পাস কিনেছে। তবে কোনোবারই ঠিকাদার সময়মতো নির্ধারিত পরিমাণে কার্ড সরবরাহ করতে পারেনি।

কার্ড সংকট কাটার আশা দিয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ডিটিসিএ র‍্যাপিড পাস ৫০ হাজার দিয়েছে, আরও দেবে। এর বাইরে এক লাখ এমআরটি কার্ড কিনতে শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করবেন তারা।

তবে ডিটিসএর এক কর্মকর্তা বলেন, সর্বশেষ ৭ অক্টোবর আড়াই লাখ কার্ড পাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু পাওয়া গেছে এক লাখ। সেখান থেকে ৫০ হাজার কার্ড মেট্রোরেলের স্টেশনগুলোতে বিক্রির জন্য সরবরাহ করা হয়েছে। তবে এসব কার্ড এক মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। ফলে এরপর কার্ড না পেলে পুনরায় সংকট দেখা দেবে।
আবার ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা বলছেন, ডিটিসিএ থেকে গোপন কোড পাওয়ার কারণে চাইলে এখন এমআরটি পাস কিনতে পারবে তারা। ইতিমধ্যে এক লাখ কার্ড কেনার অনুমোদনও পেয়েছে। তবে দরপত্রের মাধ্যমে এসব কার্ড পেতে তিন থেকে ছয় মাস লেগে যেতে পারে।

আরও পড়ুন

কার্ড হারানোদের বিপত্তি কাটছে

কার্ডের সংকটের পাশাপাশি আরেক বিপত্তি ছিল যাদের পুরোনো এমআরটি কার্ড নষ্ট হয়ে গেছে বা হারিয়ে গেছে। কারণ, সব ধরনের স্থায়ী কার্ডের নিকাশ ঘর (ক্লিয়ারিং হাউস) ডিটিসিএর নিয়ন্ত্রণে। স্থায়ী কার্ডে যাতায়াতকারীদের ভাড়া ও অব্যবহৃত টাকা জমা হয় সেখানে। এই ব্যবস্থার গোপন কোড নম্বরও ডিটিসিএর হাতে। এ জন্য নষ্ট বা হারিয়ে যাওয়া কার্ডে টাকা অব্যবহৃত থাকলে সেটি উদ্ধার করা যাচ্ছিল না।

ফার্মগেট থেকে নিয়মিত মেট্রোরেলে সচিবালয় স্টেশনে যাতায়াত করেন আসিফ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেল চালুর পরই তিনি একটি এমআরটি পাস কিনেছিলেন। সেটি গত আগস্টে হারিয়ে যায়। পরে একটি র‍্যাপিড পাস সংগ্রহ করেন। কিন্তু আগের কার্ডটিতে ৪০০ টাকা অব্যবহৃত ছিল, তা উদ্ধার করা যায়নি।
অবশ্য গত মাসের শেষ দিকে গোপন কোডটি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে দেয় ডিটিসিএ। এখন যে কেউ আগের অব্যবহৃত টাকা নতুন কার্ডে স্থানান্তর করতে পারবেন।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ বলেন, পুরোনো বা নষ্ট এমআরটি কার্ডের অব্যবহৃত টাকা এখন র‍্যাপিড পাসে স্থানান্তর করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন