পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে জন্মনিবন্ধন সহকারীর কক্ষে জন্মসনদের জন্য ভিড় করেছেন লোকজন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে
প্রথম আলো

পারিবারিক কাজে শারমিন আক্তারের জন্মসনদ প্রয়োজন। তাই এক সপ্তাহ আগে আবেদন করেছিলেন। এক-দু দিনের মধ্যে তা পেয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু পাননি। মেয়ের জন্মসনদ কবে পাবেন, তা জানতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে নিয়মিত ধরনা দিচ্ছেন বাবা কামাল উদ্দিন (৬২)। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার সকালেও এসেছিলেন তিনি। এ সময় জানানো হয়, সার্ভার ডাউন। এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করতে। এটা জানার পর ক্ষুব্ধ হয়ে কাউন্সিলর কার্যালয় ত্যাগ করেন এই বয়স্ক ব্যক্তি।

গতকাল সকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ড কার্যালয়ে এই দৃশ্য দেখা যায়। নগরের বিবিরহাট এলাকায় কাউন্সিলরের কার্যালয় অবস্থিত। আর কামাল উদ্দিনের বাসা প্রায় এক কিলোমিটার দূরের আতুরার ডিপো এলাকায়।

জরুরি প্রয়োজনের সময় দ্রুত জন্মসনদ দরকার থাকলেও তা পাননি বলে ক্ষোভ রয়েছে কামাল উদ্দিনের। কাউন্সিলর কার্যালয় ত্যাগ করার আগে তিনি বলেন, এক সপ্তাহে তিনবার এসেছেন। প্রতিবার বলেন, সার্ভার ডাউন, সার্ভার কাজ করছে না। একবার যাওয়া-আসা ৩০ থেকে ৪০ টাকা গাড়িভাড়া লাগে। সময় লাগে। জন্মসনদ পাচ্ছেন না বলে জমি বিক্রির কাজও করতে পারছেন না।

শুধু শারমিন আক্তার বা কামাল উদ্দিন নন, জন্মসনদ নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন তাঁদের মতো আরও অনেকেই। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৪১টি ওয়ার্ড আছে। এসব ওয়ার্ডে গত চার দিন ধরে জন্মসনদ ইস্যু দূরে থাক, আবেদনও করতে পারছেন না। এর আগের সপ্তাহে যাঁরা আবেদন করেছিলেন, তাঁরাও সনদ পাননি। লোকজন ওয়ার্ড কার্যালয়ে গিয়েও এর সমাধান পাচ্ছেন না।

সার্ভার ডাউন বা ধীরগতির কারণে আবেদন করা বা সনদ ইস্যু করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। দেড় থেকে দুই মাস ধরে এই সমস্যা চলে এলেও গত চার দিনে তা প্রকট হয়েছে। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছেন জন্মনিবন্ধন সহকারীরা।

‘সার্ভার নেই, পরে আসেন’

সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে জন্মসনদ পাচ্ছেন না, মানুষ মুঠোফোন ও সরাসরি এ রকম অভিযোগ করেন প্রথম আলোর কাছে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় নগরের পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, নতুন জন্মসনদ নিতে এবং পুরোনো জন্মসনদ সংশোধনের জন্য অন্তত ১০ জন জন্মনিবন্ধন সহকারীর কক্ষে জড়ো হন। তাঁদের কেউ এসেছেন সকাল ৯টায়, কেউ সাড়ে ৯টায়। জন্মনিবন্ধন সহকারী তোফায়েল আহমেদ সার্ভার জটিলতার কথা জানালেও তাতে খুব একটা আশ্বস্ত হননি। আবার কেউ কেউ সার্ভার ডাউনের কথা শুনে চলে যান। কেউ বসে থাকেন।

এ সময় কথা হয় ব্যবসায়ী শওকত ওসমানের সঙ্গে। তিনি এসেছেন ছেলের জন্মসনদ নিতে। ছেলে এখন ব্যাংক কর্মকর্তা। এখন আরেকটি ব্যাংকে চাকরির জন্য আবেদন করবেন। এ জন্য ছেলের জন্মসনদ দরকার। কিন্তু তিন দিন ঘুরেও আবেদন করতে পারেননি বাবা শওকত ওসমান। কবে পারবেন, আর করলেও কখন সনদ পাবেন, তা-ও নিশ্চিত হতে পারছেন না তিনি। এতে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাঁর কপালে।

নগরের হামজারবাগ এলাকার বাসিন্দা শওকত ওসমান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে ছেলের জন্মসনদ করেছিলেন। কিন্তু তা ছিল বাংলা আর ওই সনদ অনলাইন করা হয়নি। এখন চাকরির জন্য ইংরেজি সনদ লাগবে। একই সঙ্গে অনলাইনে থাকতে হবে। এ জন্য এসেছিলেন। কিন্তু আবেদনও করতে পারছেন না৷ এর মধ্যে চাকরিতে আবেদনের সময় ফুরিয়ে আসছে। ঠিক সময়ে জন্মসনদ না পেলে ছেলের ক্যারিয়ারের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধন সহকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানানো হয়, সার্ভার নেই, পরে আসেন।

মেয়ের জন্মসনদ সংশোধনের জন্য সকাল ৯টায় কাউন্সিলর কার্যালয়ে এসেছিলেন মো. ওসমান। অনলাইনে অনেক চেষ্টার পর আবেদন করতে পারলেও ফরম আর প্রিন্ট করতে পারেননি। এখন এর জন্য ঘুরতে হচ্ছে। কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে শুধু জানানো হয়েছে, সার্ভার কাজ করছে না।

এদিকে কলেজে ভর্তি ও অষ্টম শ্রেণি নিবন্ধনের জন্য জন্মসনদ প্রয়োজন হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীর। সার্ভার জটিলতায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। চট্টগ্রাম বন বিভাগের এক কর্মকর্তার সন্তান একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হবে। এ জন্য জন্মসনদ প্রয়োজন। কিন্তু দুই সপ্তাহ ঘুরেও তা পান না। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ডের ভারপ্রাপ্ত জন্মনিবন্ধন সহকারী তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্বাভাবিক সময় প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০টি আবেদন জমা পড়ে। এসব আবেদন দু-তিন দিনের মধ্যে দিয়ে দিতে পারতেন।

কিন্তু গত চার দিনে কোনো আবেদন নিতেও পারছেন না, সনদও দিতে পারছেন না। দেড় থেকে দুই মাস ধরেই সার্ভার ঝামেলা করছে। তবে এই চার দিন কোনোভাবেই কাজ করে যাচ্ছে না। মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের কিছু করার নেই।

একই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায় নগরে শুলকবহর ওয়ার্ডে। পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ডে যেখানে লোকজনের ভিড়, সেখানে এই ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারীর কক্ষ ছিল প্রায় ফাঁকা।

জন্মনিবন্ধন সহকারী অশোক কুমার দত্ত বলেন, সার্ভার ডাউনের কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। মানুষ বিষয়টি জেনে গেছেন। এ জন্য হয়তো লোকজন আর আসছেন না।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের নিচতলায় ডিজিটাল সেন্টারে কথা হয় দুই অভিভাবক শ্যামল মহাজন ও মোহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে। দুজনই এসেছিলেন অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের জন্মসনদের জন্য। তাঁরা বলেন, নিবন্ধনের জন্য জন্মসনদ জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে আবেদন করেও তা পাচ্ছেন না।

শুলকবহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. মোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সার্ভারের দেখভাল করা হয় ঢাকার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় থেকে। এখানে কাউন্সিলরদের কিছু করার নেই। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষ তাঁদের সমস্যার কথা বলছেন। এখন এটা দ্রুত সমাধান করা উচিত।

রোষানল থেকে বাঁচতে চান জন্মনিবন্ধন সহকারীরা

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রতিকার চেয়ে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছেন জন্মনিবন্ধন সহকারীরা। গত বুধবার এই চিঠি দেন তাঁরা। চিঠিতে বলা হয়, রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় থেকে পরিচালিত জাতীয় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সার্ভারটি কিছুক্ষণ খোলা থাকে। আবার বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। এ ছাড়াও খোলা থাকলেও অনলাইনে টাকা পরিশোধ হয় না।

জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় ভুগতে থাকা মানুষ ওয়ার্ড কার্যালয়ে এসে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনকারীদের ওপর চড়াও হয়ে দুর্ব্যবহার করছেন। এই অবস্থার প্রতিকার দরকার। সকাল থেকে বিকেল, এমনকি অনেকেই রাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করছেন। সার্ভারের জটিলতার কারণে এরপরও কাজ সম্পন্ন করা যাচ্ছে না। রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে আলাপ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে অনুরোধ জানান জন্মনিবন্ধন সহকারীরা।

গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী বিকাশ কান্তি মল্লিক সবার পক্ষ থেকে চিঠি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে তুলে দেন। বিকাশ কান্তি মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, পাসপোর্ট, স্কুল-কলেজে ভর্তি নিবন্ধন, চাকরিসহ নানা কারণে মানুষের জন্মসনদ লাগছে।

কিন্তু সার্ভার ডাউন থাকার কারণে কাজ করতে বসলে কাজ করতে পারছেন না। আবেদন জমা দিতে পারছেন না। টাকাও পরিশোধ করা যাচ্ছে না। মানুষ মনে করছেন, ইচ্ছা করে এই কাজ করছেন। এতে তাঁরা মানুষের রোষানলে পড়ছেন।

সার্ভার ডাউন থাকার কারণে মানুষ জন্মসনদ পাচ্ছেন, এমন অভিযোগের বিষয়ে রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও সার্ভার ডাউন নেই। দক্ষতার অভাবে তাঁরা নিবন্ধনের কাজ করতে পারছেন না।

আর নিবন্ধন করতে পারছেন না বলে লোকজন আবেদন করতে গেলে সার্ভার ডাউন বলে ফেরত পাঠিয়ে দেন। প্রতিটি বিষয় নিয়ম মেনে করতে হবে, তা না হলে সফটওয়্যারে তাঁরা কাজ করতে পারবেন না।