কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল

‘আমাদের বিরোধিতা খড়কুটোর মতো ভেসে যায়’

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা এবং কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে সংঘটিত ৩ নভেম্বরের পাল্টা-অভ্যুত্থানে কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল ছিলেন খালেদ মোশাররফের সঙ্গী। ২০০২ সালে মতিউর রহমান তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: কে এম সফিউল্লাহ ও শাফায়াত জামিল বিতর্ক গ্রন্থ থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে লেখাটি নেওয়া হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: মতিউর রহমান

কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল
প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: ১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্র্যাজেডির সময় আপনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৬ ব্রিগেড তথা ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক ছিলেন। এই অভ্যুত্থানের ২ মাস ১৯ দিন পর আবার ৩ নভেম্বর মুখ্যত আপনার নেতৃত্বে একটা সামরিক অভ্যুত্থান হলো। সে সময় কেন আপনারা এমন একটা পদক্ষেপ নিলেন?

শাফায়াত জামিল: ১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্র্যাজেডির জন্য দুটি বিদ্রোহী রেজিমেন্ট জড়িত ছিল। আর্টিলারি রেজিমেন্টটি ছিল আমার অধীন ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত। ট্যাংক রেজিমেন্ট ছিল সরাসরি সেনা সদর দপ্তরের অধীন। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করা; সংবিধান লঙ্ঘন করে যে অবৈধ খুনি সরকার দেশ ও জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল, তার অপসারণ করা। একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকারের মাধ্যমে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। আরও অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ ছিল যে মুক্তিযুদ্ধকালীন খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অবহিত ছিলাম। তাই তাঁর হাতে রক্তস্নাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মোটেও নিরাপদ ছিল না। পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁর তথাকথিত কনফেডারেশনের চক্রান্ত নস্যাৎ করতে ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তাঁর অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল।

১৫ আগস্ট অভ্যুত্থান-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পরপরই তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ সেটা জানতে পারেন। তারও অনেক পরে আমি বিষয়টি অবগত হই। যদিও প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমার ছিল না, তবু যখন বিষয়টি আমার গোচরে আসে, ততক্ষণে সবই শেষ।

ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সকাল নয়টার মধ্যেই তিন বাহিনীর প্রধানেরা অবৈধ খুনি সরকারের প্রধান খন্দকার মোশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ওই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর সকল কর্মকর্তা ও সদস্য শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা তথা সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়ানোর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকেন। কিন্তু ১৫ আগস্ট এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলি ৩ নভেম্বরকে অনিবার্য করে তোলে।

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার অবস্থান কী ছিল?

শাফায়াত জামিল: অভ্যুত্থানকারীদের ক্ষমতা দখলের দুই দিনের মধ্যে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত কর্নেল মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল ও নিহত) অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় আসেন। এর কয়েক দিন পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দ্বারা নিয়োগকৃত ও সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল এরশাদও বিনা ছুটিতে ও বিনা অনুমতিতে দেশে এসে উপস্থিত হন। এরশাদ তখন দিল্লিতে একটি সামরিক কোর্সে অংশ নিচ্ছিলেন। জিয়া অনাহূতভাবে দেশে আসার জন্য এরশাদকে তিরস্কার করেন এবং বঙ্গভবনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। জিয়ার বারণ সত্ত্বেও এরশাদ বঙ্গভবনে যান এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে সলাপরামর্শে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও অভ্যুত্থানের অন্যতম হোতা রশিদও ১৫ আগস্টের মাস দুয়েক আগে দিল্লিতে অবস্থান করেছিলেন। একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিধি লঙ্ঘন করে এরশাদকে কোর্সে অংশগ্রহণরত অবস্থায় পদোন্নতি দেওয়া হয়। তার চেয়েও সিনিয়র তিনজন অফিসারকে ডিঙিয়ে (ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক, ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্ত এবং ব্রিগেডিয়ার কিউ জি দস্তগীর) খুনিরা এরশাদকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে নিযুক্তি দেয়। প্রকৃতপক্ষে এরশাদই ছিলেন জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের পর অন্যতম প্রধান সুবিধাভোগী।

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: সেনাসদরের অবস্থা তখন কেমন ছিল? সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ কার হাতে ছিল?

শাফায়াত জামিল: ২৪ আগস্ট জেনারেল জিয়া চিফ অব স্টাফের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। চিফ অব স্টাফ হলেও দৃশ্যত তাঁর হাতে বিশেষ ক্ষমতা ছিল না। তাঁর ওপরে বসানো হলো চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ ও প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স অ্যাডভাইজারকে। এ দুটো পদে ছিলেন যথাক্রমে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ও জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী। সর্বোপরি ছিলেন প্রেসিডেন্ট মোশতাক। আগে চিফ অব স্টাফের ওপরে থাকতেন দুজন। এখন হলেন চারজন। তদুপরি ছিল অভ্যুত্থানকারী মেজররা। তারা ইচ্ছেমতো পোস্টিং দিচ্ছে, ট্রুপস মুভমেন্ট করাচ্ছে, ছোটখাটো সেনা অপারেশন করাচ্ছে। রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী তাদের হাতে প্রকৃত অর্থেই জিম্মি ছিল।

এ সময় সাবেক সেনাপ্রধান জিয়ার কমান্ড কত নাজুক ছিল, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সেনাসদর থেকে এক নির্দেশে বঙ্গভবনে তিনটি ট্যাংক রেখে বাকি সব ট্যাংক অবিলম্বে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনতে বলা হলো। সাত দিনের মধ্যেও বিদ্রোহীদের মধ্যে ওই নির্দেশ পালন করার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। তখন মুখরক্ষার জন্য আদেশটি বাতিল করা হলো।

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: ফারুক-রশিদের অবস্থান তখন কোথায় ছিল? তারা তো সেনানিবাসে ফিরে আসেনি।

শাফায়াত জামিল: ফারুক-রশিদ অবস্থান করত মোশতাকের সঙ্গে বঙ্গভবনে। বঙ্গভবনের ভেতরে ছিল ১২ থেকে ১৪টি ট্যাংক। বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোতায়েন করা হয়েছিল ১২টি এবং ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আরও ৮ থেকে ১০টি ট্যাংক। অর্থাৎ ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনী রয়ে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের বাইরে। জেনারেল জিয়া, খলিল বা ওসমানী—এই তিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার কারোরই নিয়ন্ত্রণ ছিল না তাদের ওপর। তাঁরা শুধু মোশতাক, ফারুক ও রশিদের নির্দেশ শুনতেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করতেন।

অন্যদিকে ডালিম, নূর, শাহরিয়ার ও অন্যরা অবস্থান করত বাংলাদেশ বেতার ভবনের অভ্যন্তরে। তারা ইঞ্জিনিয়ার্সের কিছু সেনা নিয়ে চলাফেরা করত। লেফটেন্যান্ট মাজেদ নামে একজন অফিসারও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা এ সময় ঢাকা ও এর আশপাশের বিভিন্ন লোককে এনে নির্যাতন শেষে জোর করে টাকাপয়সা আদায় করত।

নির্যাতিতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক আবিদুর রহমান এবং বিশিষ্ট রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদের এপিএসকে তো মেরেই ফেলা হয়।

অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের এসব বিশৃঙ্খল ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কার্যকলাপে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। আমার অধীন কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরাও ছিলেন অসন্তুষ্ট ও হতাশ।

প্রশ্ন:

মতিউর রহমান: একটা পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের কথা আপনি ঠিক কখন থেকে ভাবতে লাগলেন?

শাফায়াত জামিল: ১৫ আগস্টের পর থেকেই অভ্যুত্থানকারী খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার একটা চিন্তা কাজ করছিল আমার মধ্যে। সমমনা কিছু অফিসারের মৌন সমর্থনও আমার পেছনে ছিল। ১৯ আগস্ট সেনাসদরে অনুষ্ঠিত সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে ফারুক ও রশিদের উপস্থিতিতে আমি এই বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করি যে দেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। অবৈধ খুনি প্রেসিডেন্ট মোশতাককে আমি মানি না এবং প্রথম সুযোগেই আমি তাঁকে পদচ্যুত করব। অফিসারদের অনেকেই আমাকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার তাগিদ ও নৈতিক সমর্থন দিচ্ছিলেন। 

অক্টোবর নাগাদ চিফ অব স্টাফ জিয়া অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসারদের বিশৃঙ্খল কার্যকলাপের গুরুতর অনুযোগ করলেন আমার কাছে। বিশেষ করে মেজর শাহরিয়ারের ঔদ্ধত্যের একটি ঘটনা আমাকে অবহিত করলেন। আমি তাঁকে বললাম, স্যার, আপনি চিফ, আপনি অর্ডার করলে আমি জোর করে এদের চেইন অব কমান্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু জিয়া ভুগছিলেন দোটানায়। তিনি এক পা এগোন তো দু পা পিছিয়ে যান। 

আমি কিছু একটা করতে চাইছিলাম। কিন্তু তখন পক্ষ-বিপক্ষ চেনা ছিল খুবই দুরূহ। তবে বুঝতে পারছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং অন্য শৃঙ্খলাপরায়ণ ও নীতিমান কিছু অফিসারের সমর্থন আমি পাব।

যেমন অক্টোবরের প্রথম ভাগে এক দিন আমি বাংলাদেশ বেতারে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহী আর্টিলারি সেনাদল পরিদর্শনে গেলাম। সেখানে অবস্থানরত কতিপয় অফিসার সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া হলে আমাকে সমর্থন ও সহযোগিতা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। বঙ্গভবনের মেইন গেটেও আমার অধীন প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি নিয়োজিত ছিল। ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে তাদের পরিদর্শনে গেলাম এক দিন। সেদিন বিকেলে জেনারেল জিয়া খবরটা শুনে খুবই খুশি হন। তিনিও ট্রুপস পরিদর্শনে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জিয়া সম্ভবত তাঁর কমান্ড সম্পর্কে তখনো সন্দিহান ছিলেন। পরদিন চিফ অব স্টাফ জিয়াকে নিয়ে আবার ট্রুপস পরিদর্শনে গেলাম। এ সময় তাঁকে বেশ তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল। 

অক্টোবরের মাঝামাঝি কোনো এক দিন সেনাসদরে একজন প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারের (পিএসও) কার্যালয়ে রক্ষীবাহিনীর দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তা আনোয়ারুল আলম শহীদ ও সারোয়ার মোল্লার সঙ্গে অবৈধ সরকারকে প্রতিরোধ করার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করি। তাঁরা আমার সঙ্গে একমত হলেন। আমি এ কথা বলার সময় তৎকালীন পিএসও অফিস কক্ষের বাইরে ছিলেন। তিনি অফিসে ফিরতে ফিরতে আমার কথা খানিকটা শুনে ফেলেছিলেন। রুমে ঢুকে পিএসও বললেন, ‘স্যার, আপনি যদি এসব ষড়যন্ত্র করেন আমি রিপোর্ট করব।’ এই ছিল তখন সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার মানসিক অবস্থা।