মীরগড়ের রসাল টোপা 

পঞ্চগড়ে যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাঁরা টোপার রসে মজে যান
ছবি: প্রথম আলো

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ইতালির ভেনিস বন্দরের চুঙ্গিঘরে ঝান্ডুদার বাক্স-পেটরা থেকে বেরোয় এক টিন রসগোল্লা। তা নিয়ে হুলুস্থুল পড়ে যায়। বড়কর্তা এসে মুখে তুলে পাক্কা আড়াই মিনিট চোখ বন্ধ রাখেন, এরপর আরেকটি রসগোল্লার জন্য হাত বাড়িয়ে দেন।

ভিনদেশের সেই বড়কর্তার মতো রসগোল্লার রসে মজেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমনই রসে ভেজানো আরেকটি মিষ্টির নাম ‘টোপা’। হিমালয়ঘেঁষা উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি একবার খেলে আবার খেতে ইচ্ছা করবে।

পঞ্চ বা পাঁচটি গড়ের সমন্বয়ে গঠিত পঞ্চগড়। তারই একটি মীরগড়। জেলার অন্যতম জনপ্রিয় দর্শনীয় জায়গাগুলোর একটি এটি। এই মীরগড়ে পাওয়া যায় রসাল টোপা। এখানে যাঁরা বেড়াতে আসেন, তাঁরা টোপার রসে মজে যান। স্থানীয় লোকজনের মতে, পুরোনো খাবার হিসেবে টোপা মীরগড়ের ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

মীরগড় বাজারে গেলে দুই ধরনের টোপা পাওয়া যাবে। একটি চিনি দিয়ে বানানো, অন্যটি গুড়ের। একসময় টোপা বানানোর মূল উপকরণ ছিল চালের গুঁড়া আর ময়দা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এতে পরিবর্তন এসেছে। এখন টোপা বানানো হয় শুধু ময়দা দিয়ে। শুরুর দিকে টোপার আকৃতি ছিল লম্বাটে। এখন সেটি হয়েছে গোলাকার।

প্রথমে ময়দার সঙ্গে পানি মিশিয়ে মণ্ড বানানো হয়। পরে সেটা ছোট গোল মিষ্টির আকার দেওয়া হয়। এরপর তেলে ভাজতে হয়। সবশেষে তেলেভাজা মণ্ডটা মিষ্টি চিনি কিংবা গুড়ের শিরায় (রস) ডুবিয়ে রাখতে হয়। ব্যস, হয়ে গেল মজাদার রসাল টোপা।

টোপার ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতার বহু আগে মীরগড়ে আন্ধারী রানী নামের এক প্রবীণ নারী বসবাস করতেন। তিনি মজাদার এই মিষ্টি নিজ হাতে বানাতেন। পরে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করতেন। তিনিই রসাল এই মিষ্টির নাম দিয়েছিলেন টোপা। তখন প্রতিটি টোপা মাত্র দুই পয়সায় বিক্রি হতো।

মীরগড়ের টোপার ঐতিহ্য এখন পঞ্চগড় জেলার অন্যতম ব্র্যান্ড
প্রথম আলো

মীরগড় ছাড়াও এর আশপাশের এলাকায় রসাল এই মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা ছিল। ধীরে ধীরে মুখরোচক এই মিষ্টির কথা দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন মীরগড়ে টোপা খেতে আসতে শুরু করেন। খাওয়ার পাশাপাশি কিনেও নিয়ে যেতেন অনেকে।

আন্ধারী রানীর কাছ থেকে টোপা বানানোর কৌশল শিখে নেন মীরগড়ের মোমিনপাড়ার দুখু মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি। আন্ধারীর মৃত্যুর পর তিনি এই মিষ্টি বানানো শুরু করেন। স্বাধীনতার পর দুখু মারা যান। এর পর থেকে টোপা বানাচ্ছেন দুখুর ছেলে আজিজুল ইসলাম। ৪৩ বছর ধরে নিজের ছোট্ট দোকানে টোপা বিক্রি করছেন আজিজুল।

এখন টোপা বানানো ও বিক্রিতে আজিজুলকে সহায়তা করছেন তাঁর ছেলে জাহের আলী। বংশপরম্পরায় তিনিই ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির হাল ধরবেন। এ ছাড়া মীরগড় বাজারে আরও কয়েকটি দোকানে এখন টোপা বিক্রি হয়। তবে আদি-অকৃত্রিম টোপা পেতে মানুষ এখনো ভরসা করেন আজিজুল-জাহেরের ওপর। একেকটি টোপার দাম এখন পাঁচ টাকা।

টোপা শুধু একটি মিষ্টি নয়, এটি মীরগড় তথা পঞ্চগড়ের ঐতিহ্যের অংশ, বলছিলেন মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আতাউর রহমান। তাঁর ভাষ্য, মীরগড়ে বেড়াতে এসেছেন আর রসে টইটম্বুর টোপা খাননি, এমন ঘটনা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না।

মীরগড়ের এই ঐতিহ্য এখন পঞ্চগড় জেলার অন্যতম ব্র্যান্ড। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত ২০২১ সালে পঞ্চগড় জেলা ব্র্যান্ডবুকে টোপার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।