ট্রাকচাপায় অন্তঃসত্ত্বা রহিমা আক্তার মারা যাওয়ার আগে সড়কে জন্ম দিয়েছিলেন ফাতেমাকে। ট্রাকচাপায় রহিমা আক্তারের পেট ফেটে গিয়েছিল। ফাতেমার জন্ম হতে হতে ততক্ষণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ফাতেমার মা, বাবা জাহাঙ্গীর আলম ও তিন বছর বয়সী বোন সানজিদা। ১৫ দিন বয়স থেকেই ফাতেমার ঠাঁই হয় সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত রাজধানীর ছোটমণি নিবাসে। আজ রোববার ছিল ফাতেমার প্রথম জন্মদিন। নিবাসেই ফাতেমা কেক কেটেছে, নতুন জামাও পরেছিল।
গত বছরের ১৬ জুলাই ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘটা এ সড়ক দুর্ঘটনায় ফাতেমা তার বাবা, মা ও বোনকে হারায়। সে সময় ফাতেমা শুধু হাতে ব্যথা পেয়েছিল, গালে সামান্য আঘাতের চিহ্ন ছিল। সড়কে ফাতেমার জন্ম ও বেঁচে থাকাটাই একটা বিস্ময় ছিল।
ফাতেমার আপনজন বলতে এখন আছে ফাতেমার দাদা মোস্তাফিজুর রহমান, দাদি সুফিয়া বেগম, ১১ বছর বয়সী বোন জান্নাত ও ৮ বছর বয়সী ভাই এবাদুল্লাহ। এই আপনজনেরা ত্রিশালে থাকেন। জন্মদিনে আপনজনদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তবে এত কিছু বোঝার মতো বয়স হয়নি ফাতেমার। তাই কেক ও দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়মমতোই ঘুমিয়ে পড়েছিল।
নিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জানালেন, এক বছরে ফাতেমা কিছুতে ধরে দাঁড়াতে পারে। টলমল পায়ে হাঁটার চেষ্টা করে। মুখ দিয়ে কিছু শব্দ উচ্চারণ করে, তবে তা অস্পষ্ট। প্রায় সময়ই ফাতেমা হাসিখুশি থাকে।
রাজধানীর আজিমপুরের ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক জুবলী বেগম বলেন, পরিবারে বড় হওয়া শিশুদের সামনে মা, বাবা, দাদা, নানা—এ ধরনের শব্দগুলো বেশি করে উচ্চারণ করা হয়। তাই তারা এই শব্দগুলোই প্রথম উচ্চারণ করে। তবে নিবাসে বড় হওয়া স্বজন হারানো বা স্বজন না থাকা শিশুদের সামনে এ শব্দগুলো একেবারেই উচ্চারণ করা হয় না। তাই ফাতেমাও এ শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয়। কথা বলা শুরু করলে ফাতেমা সবার আগে মা বা বাবা ডাকবে তা নয়, হয়তো অন্য কোনো শব্দ বলবে। তবে ফাতেমার নাম ধরে ডাকলে বুঝতে পারে, তাকে ডাকা হচ্ছে।
জুবলী বেগম বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে ফাতেমা আমাকে দেখলেই কান্নাকাটি করছে। ছোট একটি টুকরা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলেছিল, আমি মুখ থেকে তা বের করেছি, ব্যথা পেয়েছিল। তারপর থেকেই আমাকে দেখলে কান্না করছে। ও তো আর বুঝতে পারছে না যে আমি ওর ভালোর জন্যই মুখ থেকে ওই টুকরাটা বের করেছিলাম।’
সমাজসেবা অধিদপ্তর বা ছোটমণি নিবাস ফাতেমার জন্মদিনের জন্য কোনো আয়োজন করেনি। আগে থেকেই জন্মদিনের কেক ও খাবার আনার কথা জানিয়েছিলেন যশোর-৩ আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি আজ সকালে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে নিবাসে ফাতেমা ও অন্য শিশুদের সঙ্গে নিয়ে কেক কেটেছেন। খাবারও পেয়েছে শিশুরা।
আমি যখন থাকমু না, তখন আমার নাতনির পরিচয় কী হইব? আমি নাতনিরে নিজের কাছে রাইখ্যা বড় করবার চাই।মোস্তাফিজুর রহমান, শিশু ফাতেমার দাদা
ছোটমণি নিবাসে মা-বাবার পরিচয়হীন শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী শিশু বা পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া, বাবা ও মায়ের আদালতে মামলা চলছে—এমন শিশুদের রাখা হয়। তবে ফাতেমার পরিচয় থাকার পরও থাকা-খাওয়া, চিকিৎসার কথা চিন্তা করে তাকে ছোটমণি নিবাসে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জেলা প্রশাসন। আজ নিবাসটিতে ফাতেমাসহ ছিল ২৬ শিশু। ফাতেমার মতো ছোট শিশু আছে আরও চারটি।
ফাতেমার দাদা রাজমিস্ত্রির কাজ করা মোস্তাফিজুর রহমান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাতনির জন্মদিনের কথা মনে ছিল। কিন্তু আজ তো খালি নাতনির জন্মদিন না, ছেলে, ছেলের বউ ও আরেক নাতনির মৃত্যুদিনও। তাই নাতনিরে দেখতে যাইতে পারি নাই। আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে শরীফ আহমেদের আর্থিক সহায়তায় বাড়িতে মিলাদ পড়াইছি।’
মোস্তাফিজুর রহমান জানালেন, কয়েক দিন আগে তিনি নিবাসে গিয়েছিলেন নাতনিকে দেখতে। নাতনির জন্য ইমিটেশনের গলার চেইন, হাতের চুড়ি, নতুন জামা, জুতা দিয়ে ফিরেছেন। তিনি বললেন, ‘মনে হইল নাতনি আমারে দাদাও ডাকে। ভালোই আছে নাতনি।’
মোস্তাফিজুর রহমান নাতনিকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চান। তিনি জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় গত জানুয়ারি মাসে আবেদন করেছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমি যখন থাকমু না, তখন আমার নাতনির পরিচয় কী হইব? আমি নাতনিরে নিজের কাছে রাইখ্যা বড় করবার চাই।’
মোস্তাফিজুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় ২০০৪ সালে হারিয়েছেন ১৩ বছর বয়সী এক ছেলেকে। গত বছর হারান আরেক ছেলে, ছেলের বউ ও এক নাতনিকে। ১৯৯৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান মোস্তাফিজুর রহমানের এক ভাই। তাঁর আপন তিন মামাও মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়।
সড়কে ফাতেমার জন্মের পর নবজাতককে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও তার কল্যাণ নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই আইনজীবী কানিজ ফাতিমা তুনাজ্জিনা হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। গত বছরের ৩০ আগস্ট ফাতেমার আইনগত অভিভাবক হিসেবে মোস্তাফিজুর রহমানকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে সড়ক পরিবহন আইনের ৫৪ ধারা অনুসারে গঠিত ট্রাস্টি বোর্ড। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক বাড়ি করার জন্য আরও পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে। বিভিন্ন সংস্থাও সহায়তা দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোস্তাফিজুর রহমানকে একটি ব্যাংক হিসাব খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারেন বলে জানালেন মোস্তাফিজুর রহমান।