জলে ভাসা পদ্মজীবন

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনার লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: আরাফাত করিম

২০১১ সালের কথা। আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। মা-বাবাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আমি কাজ করতে যাব দক্ষিণ দেশে। আমাদের নীলফামারী জেলার মানুষ দক্ষিণ দেশ বলতে ঢাকা-টাঙ্গাইল—এসব জায়গাকে বোঝাত। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে হাজার হাজার গরিব মানুষ নীলফামারী থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইলে যেত কাজের আশায়। শ্রমিক বিক্রি হতো দুবেলায়। সকালে আর বিকেলে।

হাইস্কুল-কলেজজীবনে আমি ১৮ বার ঢাকা ও আশপাশের জেলায় কাজে গিয়েছি। কী কষ্টের দিন ছিল সেসব! বিরাট শ্রমিকের বাজার বসত। সেসব বাজারে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। গেরস্তরা পছন্দমতো দরদাম করে নিয়ে যেত। কাজ শেষ হলে রাতে আবার বাজারেই ফিরে আসতাম। দোকানের বারান্দায়, স্কুলের বারান্দায় শুয়ে কত রাত কেটে গেছে। শীতের কুয়াশা কত কাঁপিয়ে দিয়েছে। আবার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ঝড়বৃষ্টি এসে কত আধা ঘুম ভেঙে দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে! যেন জলে ভাসা পদ্মজীবন!

প্রথম যখন টাঙ্গাইল যাই, সেই প্রথম বাসে উঠি; তা-ও একদম পেছনের সিটে। কিছুক্ষণের মধ্যে কয়েকবার বমি করি। বুক জ্বলে, গলা ব্যথা করে, তার ওপর সারা দিন না খেয়ে থাকা। অনেক কান্না করি।

টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে এভাবেই আমি প্রথম যমুনা নদী ও বঙ্গবন্ধু সেতু দেখি। কৃষ্ণ বড়বাবা, তারক কাকা আর আমি মিলে তিনজন সেবার কাজে যাই। বাস টাঙ্গাইলে পৌঁছালে তারক কাকা নামতে বলেন। আমরাও ঘুমের ঝোঁকে নেমে পড়ি বাস থেকে।

নেমে দেখি এটা টাঙ্গাইল সদর আর আমরা যাব টাঙ্গাইলের পাকুল্লায়। এদিকে আমাদের বাস চলে যায়। এখন কী হবে! এই রাস্তা এখন আমরা কী করে যাব? আমাদের তিনজনের কাছে কোনো টাকাও নেই যে আবার কোনো গাড়ি ধরব। হাঁটা শুরু করি। আমাদের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে বাস-ট্রাক যায়। এসব দেখলে মাথা ঘুরে ওঠে, সারা দিন কোনো খাওয়া হয়নি। কাঁদতে কাঁদতে হাঁটি। সন্ধ্যা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত হেঁটে আমরা পাকুল্লায় পৌঁছাই। সেখান থেকে গেরস্তের বাড়ি যেতে আরও ১৩ কিলোমিটারের হাঁটা পথ। কী যে কষ্ট! 

অবশেষে হেঁটে ভোর চারটায় পৌঁছাই গেরস্তের বাড়ি। গেরস্তের বউ আমাদের পেঁয়াজ, মরিচ ও লবণ দিয়ে পান্তা ভাত দিলেন। ততক্ষণে ভোর হয়ে গেছে। খাওয়ার পর গেরস্ত জানালেন, তাঁর বাড়িতে কাজ নেই। পাশের পাড়ায় যেতে বললেন। সেই পাড়ায় আমি প্রথমবারের মতো শ্রমিক হিসেবে বিক্রি হই ৮০ টাকায়।

একবার টাঙ্গাইলের পানিসাইল গ্রামে বৈশাখের মাঝামাঝি সময় ধান কাটার শ্রমিক হিসেবে যাই। সারা দিন কাজ করতাম আর রাতে একটু করে লুকিয়ে বই পড়তাম। রাতে বই পড়ার সময় একদিন গেরস্তের বউ অর্থাৎ আন্টি দেখে ফেললেন। আন্টি তো একদম হল্লা শুরু করে দিলেন। ‘কামলা মানুষ বই পড়ে গো দ্যাহো...!’ সবার মুখে মুখে রটে গেল এ কামলা যেনতেন কামলা নয়, এ হলো শিক্ষিত কামলা!

একদিন সারা দিন কাজ করে সন্ধ্যায় গেরস্তের ঘরে টিভি দেখতে গিয়ে আন্টিকে বলি, রুমঝুম কই? রুমঝুম আন্টির একমাত্র মেয়ে। দুই বছর বয়স। রুমঝুমের কথা বলতেই আন্টি অবাক হয়ে তাকান আমার দিকে। কেননা সবাই বাড়ির কাজে এত ব্যস্ত যে রুমঝুম কোথায়, কেউ জানে না। খোঁজা শুরু হলো রুমঝুমকে। কোথাও পাওয়া গেল না। রুমঝুমের মা চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন এবং কিছুক্ষণ পর দাঁত লেগে অজ্ঞান হন।

আমি দাঁত লাগা খুলিয়ে ও জ্ঞান ফিরিয়ে চিৎকার করে বলি, রুমঝুম যদি ডাঙায় থেকে থাকে তাহলে সে নিরাপদেই আছে, তবে সে যদি পুকুরে যায়, তাহলে নিরাপদে নেই। গেরস্তের বাড়ির দুই দিকেই পুকুর। আমিসহ কয়েকজন একটাতে গেলাম। আরও কয়েকজন আরেকটাতে গেল। অবশেষে আমিই রুমঝুমকে পানিতে আধা ডুবো অবস্থায় দেখতে পেলাম এবং তুললাম। রুমঝুমের পেটভর্তি পানি। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছে না। আমি কেঁপে ও কেঁদে উঠলাম। বড় একটা কান্নার রোল পড়ে গেল। রুমঝুমকে উপুড় করে চাপ দিলাম। পেট থেকে পানি বের হলো না। আমার মাথায় পেট রেখে ঘুরালাম কয়েকবার। তবু কাজ হলো না। পরে পা ধরে ঘুরাতেই মুখ দিয়ে বমি করে রুমঝুম। বমি করার পরেই কেঁদে ওঠে। আমি চিৎকার করে বলি, বেঁচে আছে। মেডিকেলে নিয়ে যেতে হবে। 

রুমঝুমকে যখন মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন ও আমার বুকেই ছিল। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে কী যে কষ্ট হচ্ছিল ওর। মাঝেমধ্যে অনেক কষ্ট করে কেঁদে উঠছিল। হেঁচকি কাটছিল খুব। মির্জাপুর পৌঁছে এক ক্লিনিকে গিয়ে অক্সিজেন লাগানো হলো। জরুরি বিভাগ থেকে একজন ডাক্তার এসে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর একটু ভালো হতে শুরু করল রুমঝুম। রাত তখন সাড়ে ১২টা। আমরা ফেরার পথ ধরলাম।