বিদ্যুতের অবৈধ খুঁটি, বিপন্ন বন ও হাতি 

সংরক্ষিত বনে বিদ্যুতের অবৈধ ১০ হাজার খুঁটির সন্ধান পেয়েছে বন বিভাগ।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন চুনতি সংরক্ষিত বনের ভেতরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির স্থাপন করা বৈদ্যুতিক খঁুটিছবি: বন বিভাগের সূত্রে প্রাপ্ত

নানামুখী দখলে কমতে থাকা দেশের বনভূমির জন্য নতুন বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে বনের ভেতরে স্থাপন করা বিদ্যুতের ১০ হাজার খুঁটি। বনের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা হাজার হাজার অবৈধ বসতিতে এসব খুঁটি থেকে সংযোগ দেওয়া হয়েছে।

বন বিভাগ বলছে, অবৈধ বসতিতে বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়া সহজ হওয়ায় বন দখলের ঘটনা বাড়ছে। অন্যদিকে বনাঞ্চলে মহাবিপদাপন্ন হাতির চলাচল বন্ধ করতে বিদ্যুতের এসব খুঁটি থেকে সংযোগ দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে হাতি।

বন বিভাগের নথি বলছে, ২০১৬ সাল থেকে এ রকম ২৬টি হাতি বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়েছে। এ বছর (২০২৫) চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও দিনাজপুর অঞ্চলের বনাঞ্চলে বিদ্যুতের কী পরিমাণ খুঁটি আছে, সেটার একটা জরিপ করেছে বন অধিদপ্তর। জরিপে ১০ হাজার খুঁটির সন্ধান পেয়েছে বন বিভাগ।

আমি এ বিষয়ে জানতাম না। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

সবচেয়ে বেশি বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে। এখানে আছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৫ হাজার ৭১৭টি খুঁটি। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে দিনাজপুর অঞ্চল। এখানে ২ হাজার ৬৭টি। তৃতীয় অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে খুঁটির সংখ্যা ৯৬২। এরপর চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের আওতায় রয়েছে ৭২৫টি।

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জানতাম না। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।’

আমলে নেওয়া হচ্ছে না বন বিভাগের উদ্বেগ

বিদ্যুতের সংযোগ পেতে যেকোনো নাগরিককে কমপক্ষে পাঁচটি নথি জমা দিতে হয় সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ অফিসে। এর মধ্যে একটি হলো জমির মালিকানার সপক্ষে বৈধ কাগজপত্র। তবে বনের জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতিতে বিদ্যুতের সংযোগ পেতে প্রয়োজন হচ্ছে না জমির বৈধ কাগজপত্র।

এসব খুঁটি সরিয়ে নিতে বারবার চিঠি দেওয়া হলেও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও পিডিবি থেকে সাড়া পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ বন বিভাগের।

■ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বনের জায়গায় জবরদখলকারী আছে প্রায় ৩৯ হাজার। ■ এ দুই জেলায় বনভূমি দখল হয়েছে মোট ৪৯ হাজার একর। ■ বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে ৮ বছরে ২৬টি হাতি হত্যা।

জানতে চাইলে বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যত খুঁটি আছে বনের ভেতর, সবই অবৈধ। অবৈধ দখলদারদের এসব খুঁটি থেকে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে বিভাগীয় বন কার্যালয় (ডিএফও) থেকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম্যানেজার ও ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারদের চিঠি দিয়ে এসব খুঁটি সরিয়ে নিতে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। কক্সবাজারের রামুতে এ রকম খুঁটি থেকে বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে হাতি হত্যার ঘটনায় পল্লী বিদ্যুতের জিএমের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বন বিভাগ। এ ছাড়া নিয়মিত জেলা পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সভা ও উন্নয়ন সমন্বয় সভায় এ বিষয়গুলো উত্থাপন করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক সভায় এসব খুঁটি সরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবু খুঁটি সরানো হয়নি।

বিদ্যুতের খুঁটির বিষয়ে বন বিভাগ থেকে আপত্তি জানিয়ে আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওনাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দুটি খুঁটি থেকে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া এলাকার বিউবির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো. শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে অনেক গরিব লোক আছে, যাদের ভূমি নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, বাংলাদেশে যার জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, সে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার রাখে।’ তবে বন বিভাগ আপত্তি দিলে তাঁরা সেখানে খুঁটি স্থাপন করেন না দাবি করে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বন বিভাগ কখনো এ রকম অভিযোগ করেনি। বনের ভেতরের বাড়িঘরে আমরা কোনো সংযোগ দিই না। অজ্ঞাতসারে চুরি করে কেউ নিতে পারে বিদ্যুতের সংযোগ, কিন্তু আমাদের জ্ঞাতসারে এ রকম কোনো সংযোগ আমরা দিই না।’

বিদ্যুৎ, সড়ক আর পানি সহজলভ্য হলে বনের ভেতর অবৈধ দখল কেউ থামাতে পারবে না। বনের পরিবেশ থাকবে না, বন্য প্রাণীর বিচরণও কমে যাবে।
অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন রাজু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। বনের ভেতরে কীভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।’ তিনি জানান, বন বিভাগ থেকে চিঠি দিয়ে বিদ্যুতের খুঁটি সরানোর বিষয়ে তাঁদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন প্রথম আলোকে বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তাদের কিছু দালাল আছে। তাদের সহযোগিতায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বনের ভেতরে এসব সংযোগ দেওয়া হয়।

বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে হাতি হত্যা

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বনের জায়গায় জবরদখলকারী আছে প্রায় ৩৯ হাজার। এ দুই জেলায় বনভূমি দখল হয়েছে মোট ৪৯ হাজার একর। এখানে বনভূমি দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বসতবাড়ি ও নানা ধরনের বাণিজ্যিক বাগান। এসব বাগানের ভেতর দিয়ে ও আশপাশে যাতে হাতি বিচরণ করতে না পারে, সে জন্য বিদ্যুতের সংযোগ দিয়ে হাতি মারার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। ২০১৬ সাল থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে এভাবে ২৬টি হাতি হত্যা করা হয়েছে বলে বন বিভাগ জানিয়েছে।

সম্প্রতি বন বিভাগ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিউবি) দেওয়া এক চিঠিতে বনের ভেতর খুঁটি স্থাপনের কারণে বনের অখণ্ডতা নষ্ট এবং বনভূমিতে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ও স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হচ্ছে বলে জানানো হয়। চিঠিতে এসব খুঁটি ব্যবহার করে হাতি হত্যা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।

আমি সম্প্রতি যোগ দিয়েছি। বনের ভেতরে কীভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখা হবে।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন রাজু

জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া এলাকার বিউবির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যুতের খুঁটির বিষয়ে বন বিভাগ থেকে আপত্তি জানিয়ে আমাদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ওনাদের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দুটি খুঁটি থেকে বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের অধ্যাপক মো. কামাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুতের সংযোগ পাওয়ায় বনের ভেতরে বাড়িঘর করার একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক যেটা, বিশেষ করে চকরিয়া ও কক্সবাজার এলাকায়, সেটা হলো এসব বিদ্যুৎ দিয়ে বেশ কয়েকটি হাতি হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, সড়ক আর পানি সহজলভ্য হলে বনের ভেতর অবৈধ দখল কেউ থামাতে পারবে না। বনের পরিবেশ থাকবে না, বন্য প্রাণীর বিচরণও কমে যাবে।


[তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রতিনিধি, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম]