বিশ্ব সাইক্লিংয়ের আসরে উড়ল লাল-সবুজের পতাকা
টোবিয়াস ফস, স্টিফেন কুং, রেমকোদের রেস তখনও শেষ হয়নি। সবার নজর তাঁদের দিকেই। বিশ্বসেরা এই তিন সাইক্লিস্ট থেকে প্রায় ১৯ মিনিট পিছিয়ে থেকে ফিনিশ লাইন ছুঁলেন লাল–সবুজ জার্সি পরা এক তরুণ। প্রেসবক্স পার হওয়ার সময় এক সাংবাদিক এসে ধরলেন তাঁকে। প্রথম জিজ্ঞাসা, রেইনবো ব্যান্ডের দখল নিতে তামাম দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব সাইক্লিস্ট জানপ্রাণ লড়ে গেল। আর তুমি এত পিছিয়ে থাকলে কেন? স্মিত হেসে তরুণ বললেন, ‘আমি ক্লান্ত–বিধ্বস্ত। পিছিয়ে পড়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু আমি আমার সবটুকু নিংড়ে দিয়েছি।’ পরোক্ষণেই আবার বললেন, ‘এ অবধি আসতে পেরেছি, এই তো ঢের; আমি তাতেই খুশি।’
লাল–সবুজের জার্সি পরা এই তরুণের নাম দ্রাবিড় আলম (৩৮)। ইউসিআই রোড ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে তিনিই প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন। বাঘা বাঘা সাইক্লিস্টের সঙ্গে টেক্কা দেওয়া নয়, স্রেফ লাল–সবুজের পতাকাটা সাইক্লিংয়ের বিশ্ব আসরে তুলে ধরাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। এ জন্য মাত্র সপ্তাহ চারেক আগে খাগড়াছড়িতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক চোটকেও আমলে নেননি। কবজি ফেটে, কাঁধে চোট লেগে, কপালে সেলাইও পড়েছিল কয়েকটা। নেহাত মনোবল, আর একনিষ্ঠ অনুশীলনের জোরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াতে পেরেছেন।
এবার সাইক্লিংয়ের ইন্ডিভিজ্যুয়াল টাইম ট্রায়ালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ানশিপের আসর বসেছিল অস্ট্রেলিয়ার সিডনির উলনগংয়ে। বিভিন্ন দেশের ৪৮ জন প্রতিযোগী এবারের রেসে অংশ নিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় সাইক্লিং নিয়ে লেখালেখির জনপ্রিয় সাইট ‘সাইক্লিংটিপস’ দ্রাবিড়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। ফিনিশিং লাইন ছোঁয়ার পরপর সেই সাক্ষাৎকারে দ্রাবিড় বলেছিলেন, ‘সাইক্লিং নিয়ে কথা বললে প্রথমেই হয়তো বাংলাদেশের নাম আপনার মাথায় আসবে না। কিন্তু সেখানে (বাংলাদেশে) সাইক্লিং করেন, এমন অসংখ্য তরুণ আছেন। বাংলাদেশে সাইকেলের রীতিমতো গণজোয়ার চলছে। তাই বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সাইক্লিং সম্পর্কে জানাতে এ পর্যন্ত আসতে চেয়েছিলাম। আর এটা করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।’ কিন্তু সিডনি অবধি আসার পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না গিনেস রেকর্ডধারী এই তরুণের।
এক ঝলক:
দ্রাবিড় আলম
বয়স ৩৮
সদস্য: টিমবিডিসি
রেকর্ড: ৪৮ ঘণ্টায় চারজন মিলে রিলে করে ১৬৭০ কিলোমিটার সাইকেল চালানোর গিনেস রেকর্ড
পাহাড়ে দুর্ঘটনা
রোডবাইকে অভ্যস্ত দ্রাবিড় মাস চারেক আগে টাইম ট্রায়াল (টিটি) বাইক নিয়েছেন। নতুন সাইকেলে অভ্যস্ত হতে ট্রেনিংয়ের জন্য গত ১১ আগস্ট গিয়েছিলেন খাগড়াছড়ি। সপ্তাহখানেক সব ঠিকঠাক চলছিল। দুর্ঘটনাটা ঘটে ১৮ আগস্ট সকালে। সিন্দুকছড়ি পাহাড় থেকে নামার সময় একটি অটোরিকশা আচমকা উল্টো দিকে ঘুরতে যায়। সময়মতো ব্রেক কষেও শেষ রক্ষা হয়নি। রাস্তায় আছড়ে পড়লেন দ্রাবিড়।
ঘণ্টাখানেকের মাথায় হাসপাতালে পৌঁছার পর ডান হাতে প্লাস্টার আর কপালে সেলাই পড়ল। ঢাকায় ফিরে আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর কবজিতে ফাটলের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেল। সঙ্গে কাঁধে চোট তো আছেই।
এদিকে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা হয়ে গেছে। উড়োজাহাজের টিকিট কাটাও শেষ। শেষ মুহূর্তে সব ভন্ডুল হওয়ার পথে। তবে ফিজিওথেরাপিস্টরা শোনালেন আশার কথা, ফাটলটা গুরুতর না। নতুন একটা যন্ত্র এসেছে। সেটা দিয়ে থেরাপি দেওয়া গেলে তিন সপ্তাহের মধ্যে ভালো ফলের আশা আছে।
প্লাস্টার করা হাত নিয়েই ঘরে টিটি বাইকে ট্রেনিং চালিয়ে গেলেন দ্রাবিড়। ‘সেটা অবশ্য আমার জন্য একদিকে ভালোই হয়েছে। টিটি বাইকটা ভালোমতো রপ্ত হয়ে গেছে। সঙ্গে ৫ কেজি ওজনও কমিয়ে ফেলেছি’, বললেন দ্রাবিড়। ৮ সেপ্টেম্বর প্লাস্টার খোলার পর হাত কাজ করছিল না। অসাড় হাতটাকে কেজো করে তুলতে হাতে সারাক্ষণ একটা স্কুইজ বল রাখতেন। ১১ সেপ্টেম্বর সিডনির উদ্দেশে দেশ ছাড়েন দ্রাবিড়।
সিডনির পথে
সিডনিতে দ্রাবিড় গিয়ে উঠলেন ব্ল্যাকটাউনে পরিচিত এক বাঙালির বাড়িতে। সেখানে সাইকেলের জন্য আলাদা একটা সড়ক আছে। নাম এম সেভেন সাইকেলওয়ে। ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেই সড়কে নিয়মিত প্রশিক্ষণ করতে লাগলেন। তখনো চূড়ান্ত পর্বে দ্রাবিড়ের নাম নিশ্চিত হয়নি। সাইক্লিংয়ের আন্তর্জাতিক গভর্নিং বডি ইউসিআইয়ের (ইউনিয়ন সাইক্লিং ইন্টারন্যাশনাল) সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বহু চেষ্টার পর রেসের আগের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর দ্রাবিড়কে রেসে নামার অনুমতি দিল ইউসিআই।
এদিকে অস্ট্রেলিয় আরেক সাইক্লিস্ট ড্যারিন টাকারের সঙ্গে পরিচয়টা বেশ কাজে দিয়েছিল। টাকার কয়েকবার ঢাকায় এসেছেন। দ্রাবিড়দের টিমবিডিসির সদস্যদের সঙ্গে সাইকেলও চালিয়েছেন। সিডনিতে টাকারদেরও একটা ক্লাব আছে। সে ক্লাবের সাইক্লিস্টরা অনেক উৎসাহ জুগিয়েছেন দ্রাবিড়কে।
১৮ সেপ্টেম্বর সিডনির স্থানীয় সময় বেলা সোয়া তিনটায় দ্রাবিড়ের রেস শুরু হয়। ৪৮ জনের মধ্যে ২৮ নম্বরে নেমেছিলেন দ্রাবিড়। প্রতি ৯০ সেকেন্ড অন্তর একেকজন সাইক্লিস্টকে ছাড়া হচ্ছিল। দ্রুততার সঙ্গে ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে।
হাতের ব্যথার তখন কী অবস্থা জানতে চাইলে দ্রাবিড় বলেন, ‘রেসের আগে এসে আমি একদম ফিট। তখন আসলে এসব মাথায় কাজ করছিল না। এক ঘণ্টা সাইকেল চালিয়েছি। পানি খাওয়ার কথাও মাথায় আসেনি।’
পরেরটা শুধুই তরুণদের
রেসটা হয়েছিল সাগর–পাহাড়ঘেঁষা শহর উলনগংয়ে। অনেক চড়াই–উতরাই ছিল রেসে। হালকা রোদ, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। তবে বাতাস ছিল খুব। সাইকেলে ওঠার খানিক পরেই কানে ভেসে এল, কাদের যেন ‘বাংলাদেশ’ আর ‘দ্রাবিড়’ বলে গলা ফাটানো চিৎকার। তাঁকে খুব উৎসাহ দিচ্ছিল সবাই। ওরা যতই চিৎকার করে, দ্রাবিড়ের গতি ততই বাড়ে। এটা তাঁকে খুব অবাক করে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এত লোক তাঁকে চেনে কী করে! পরে জেনেছিলেন, এঁরা সবাই ড্যারিন টাকারের সাইক্লিং ক্লাবের সদস্য।
বাংলাদেশ থেকে প্রথম কেউ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে এল। তা–ও হাত ভাঙা। সে লড়ছে—এটাই সবাইকে অনুপ্রাণিত করছিল। তাই সবাই তাঁকে উৎসাহ দিচ্ছিল খুব।
রেসে সবচেয়ে তরুণ প্রতিযোগীর বয়স ছিল দ্রাবিড়ের অর্ধেকেরও কম—১৮। ‘তাতে কিছু যায় আসে না’, মন্তব্য দ্রাবিড়ের। তিনি একটা দোয়ার খুলে দিয়েছেন। এবার বাকি কাজটা তরুণদেরই করতে হবে। ইতিমধ্যে আরও কিছু তরুণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁরা বিশ্ব আসরে বড় বড় প্রতিযোগিতায় লড়বেন, ভালো অবস্থান করে নেবেন—এমনটাই আশা তাঁর।