তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক ভূমিকা উপেক্ষিত থেকেছে: মাহ্‌ফুজ আনাম

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জন্মশতবর্ষ স্মরণানুষ্ঠানে’ বক্তব্য দেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামছবি: জাহিদুল করিম

মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পরবর্তী সময়ে উপেক্ষার শিকার ছিল বলে মন্তব্য করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। তিনি বলেন, ‘এ জায়গায় আমরা ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিষ্ঠানগতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বে আক্রান্ত।’

তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত এক স্মরণানুষ্ঠানে মাহ্‌ফুজ আনাম এ কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জন্মশতবর্ষ স্মরণানুষ্ঠানে’র আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

অনুষ্ঠানে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘আমি স্মরণ করতে চাই, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কী ধরনের চেতনা ও আলোচনা আমরা করেছি, সেটা নিয়ে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার যাত্রা শুরু করে। এরপর আমাদের একটা বিরাট বিতর্ক তৈরি হলো বাকশাল নিয়ে। সব কাগজ বন্ধ করে দেওয়া হলো, সব দলকে নিষিদ্ধ করা হলো।’

এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যাত্রায় প্রথম ধাক্কা মন্তব্য করে মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘এরপর আমরা দেখলাম বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যা। বাংলাদেশে অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে আমরা কোনো দিনই ভাবি নাই আবার সেনাবাহিনী আসবে, তারা দেশ পরিচালনা করবে। আমরা ১৯৭৫ থেকে ’৯১ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেনাশাসনের মধ্যে থাকলাম।’

সেনাশাসকদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান নিয়ন্ত্রণ করার একধরনের চেষ্টা ছিল উল্লেখ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, ‘সুষ্ঠু ও বস্তুনিষ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা পেলাম না। এরপর আমরা গেলাম গণতন্ত্র (১৯৯১)। সেখানে বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে সম্পূর্ণভাবে অন্যদিকে প্রবাহিত করার একটা উদ্যোগ দেখলাম। তারপর শেখ হাসিনার সরকারে সেটার বিপরীত যাত্রা দেখলাম।’

পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার সরকার ও সর্বশেষ হাসিনার সময়ে বস্তুনিষ্ঠ বয়ান তৈরি হয়নি মন্তব্য করে মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর উদ্‌যাপন করলাম, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার দিকে চলে গেল। জনসাধারণ ও লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা—তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁদের প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের ঘটনা ৫০ বছরের উদ্‌যাপনের মধ্যে দেখিনি।’

ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, ‘এ পুরো ধারাবাহিকতার মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের যে ভূমিকা, সেটা বারবার বলতে পারেন যে উপেক্ষিত হলো। কোনো দিন আমরা ওইভাবে তাঁর অবদান (স্বীকারের বিষয়টি) পাইনি। তাজউদ্দীন আহমদ যে একজন মহান ব্যক্তিত্ব, তাঁর নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, সততা ও নৈতিকতা—সবকিছু নিয়ে তিনি সত্যিকার অর্থে অনন্য ব্যক্তিত্ব।’

মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘আজকে যে জন্মশতবর্ষ খুব সীমিতভাবে উদ্‌যাপন হচ্ছে, আরও যে ব্যাপক আকারে উদ্‌যাপন হচ্ছে না; বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, চিন্তক সংগঠন, তারাও যে ওনার জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপন করছে না, এটাই প্রমাণ করে যে আমাদের ইতিহাসের প্রতি একটা অনীহা। এ জায়গায় আমরা ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিষ্ঠানগতভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বে আক্রান্ত।’

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ ও বঙ্গবন্ধুর যে একটা নৈকট্য ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, পুরো বিষয়টি মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠের মতোই। জনগণকে জাগিয়ে তোলার মতো বঙ্গবন্ধুর যে বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা, সেটা তাজউদ্দীন আহমদের ছিল না। তবে তাজউদ্দীনের দলকে সুসংগঠিত করার, গোছানোর অনন্য ক্ষমতা ছিল।

বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠানের শুরুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়
ছবি: জাহিদুল করিম

এ দুজনের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব ছিল না উল্লেখ করে মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘নেতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন। তাঁদের মধ্যে এমন কোনো রকম রাইভালরি (দ্বন্দ্ব) ছিল না যে দলের নম্বর টু (দ্বিতীয় প্রধান) হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ অস্বস্তি বোধ করেছেন। এটা ছিল ব্যক্তিগত আস্থা ও রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দারুণ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক।’

এ সম্পর্ককে চীনের বিপ্লবের নেতা মাও সে-তুং ও চৌ এনলাইয়ের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, তাজউদ্দীন আহমদের রেখে যাওয়া উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার মধ্যে গণমুখী রাজনীতি কীভাবে করতে হয়, সেটার নিদর্শন আছে।

অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, ‘স্বাধীনতার তিনটি পর্ব রয়েছে। এ তিনটি পর্বে তাজউদ্দীন আহমদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ সত্যকে ধারণ করা খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।’

সারওয়ার আলী বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ এ দেশের মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করেছেন। নিজের মেধা, চারিত্রিক দৃঢ়তা নিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার পুরো ৯টি মাস অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। এটা স্বীকার করতে হবে যে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ দেশের জন্য মঙ্গলজনক হয়নি।

স্মরণানুষ্ঠানের শুরুতে তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতির উদ্দেশে সংগীত পরিবেশন করেন সংগীতশিল্পী তানিয়া মান্নান। অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৫২ সালের ডায়েরি থেকে পাঠ করেন মহিউদ্দিন শামিম। ১৯৬৬ সালে কারাবাসকালে ছোট বোন মরিয়মকে লেখা তাজউদ্দীন আহমদের একটি চিঠিসহ মোট তিনটি চিঠি পাঠ করে শোনান আবৃত্তিশিল্পী শহিদুল ইসলাম নাজু। তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতির উদ্দেশে সিদ্দিক আবু বকরের লেখা কবিতা ‘তাজ নামে এক প্রাণ’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন আবৃত্তিশিল্পী মাহিদুল ইসলাম।

সবার শেষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সদস্যসচিব মফিদুল হক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন। পুরো সময় দর্শকসারিতে বসে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদ।

বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠানের শুরুতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।