পিতৃহৃদয় 

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনার লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

স্থানীয় এক সাংবাদিক কল দিয়ে বললেন, ‘থানায় একটা বৈঠক আছে। দাম্পত্য সমস্যা। ছেলেপক্ষ আমার আত্মীয়। থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে। ফ্রি থাকলে চলে আসেন বিকেলে।’

শুক্রবার কাজ ছিল না হাতে। হাজির হলাম থানায়। দুই পক্ষের লোকজন বসে আছেন। আমি ঢোকামাত্রই কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল।

থানার এসআই বললেন, ‘ছেলের পক্ষ থেকে একটা অভিযোগ পেয়েছি, আপনারা মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠাচ্ছেন না এক বছর। ঘটনা কী, বলেন তো।’

মেয়ের বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মেয়ের বিয়ের সময় দেড় ভরি ওজনের একটা গলার হার দিয়েছিলাম। বিয়ের এক মাস না যেতেই জামাই মেয়েকে চাপ দিতে শুরু করে, হার বিক্রি করে তাকে মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে। আমি গরিব মানুষ। গরু–ছাগল বিক্রি করে মেয়েকে স্বর্ণ দিয়েছি, সেটা বিক্রি করে দিলে মেয়েটার গলা খালি হয়ে যাবে।’

বাবার কথা শেষ না হতেই মেয়ে কেঁদে কেঁদে বললেন, ‘আমাকে প্রায়ই এটা নিয়ে মারধর করত। বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায় হাঁড়িপাতিল ধুতে দেরি হওয়ায় আমার দেবরও আমাকে মারধর করেছে।’

মেয়ের কোলে ছয় মাসের বাচ্চা এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। মায়ের কান্নার শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল। একজন উঠে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন রুমের বাইরে।

এসআই বললেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন মেয়ের স্বামী মেয়েকে নিতে চাইছে। সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে হবে। মেয়েরও কিছু ভুলত্রুটি আছে। এখানে দুই পরিবারের লোকজন আছেন, এলাকার গণ্যমান্য লোকও আছেন। সবার সামনে দুই পক্ষ লিখিত অঙ্গীকার করবেন, আগের ভুলগুলো পুনরায় যেন না হয়। আমরাও কিছু কথাবার্তা বলে দেব। যে পক্ষ অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে, তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ছেলের বাবা এতক্ষণ চুপ করেছিলেন। এসআইয়ের কথা শেষ হতেই বললেন, ‘এতক্ষণ তো আমাদের দোষত্রুটির কথা সবাই শুনলেন। আমার নির্দোষ ছেলেকে তার শ্বশুর যে মারধর করে থানায় দিয়েছে, সেটার বিচার কী হবে?’

এসআই বললেন, ‘এই ঘটনা আবার কখন ঘটল? অভিযোগ যেটা করেছেন, সেখানে তো এসব কিছু লেখা নেই।’

মাথা নিচু করে এক কোনায় বসে ছিল ছেলে। ছেলের উদ্দেশে বাবা বললেন, ‘বল, কী কারণে তোকে মেরে থানায় ঢুকিয়েছিল।’

মাথা নিচু করেই বলে গেল একটানা।

‘বাচ্চা হওয়ার পর আমি লোক মারফত বারবার শ্বশুরবাড়িতে খবর পাঠিয়েছি বাচ্চাকে একনজর দেখার জন্য। কিন্তু তারা রাজি হয়নি। এক মাস চেষ্টার পর পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে কথা বলে বাচ্চার মাকে রাজি করাতে পারি। রাতের বেলা বাচ্চাকে লুকিয়ে একনজর দেখেই চলে যাব, এই শর্তে বাচ্চার মা রাজি হয়। দিনক্ষণ ঠিক করে একদিন রাতে বাচ্চাকে দেখার জন্য লুকিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাই। আমার শাশুড়ি ঘুমে ছিলেন, শ্বশুর ঘরে ছিলেন না।’

পিনপতন নীরবতা। সবাই মন দিয়ে শুনছে।

‘ঘরের পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাচ্চাকে নিয়ে আসে তার মা। অনেক জোরাজুরির পর বাচ্চাকে কোলে নিতে পারি। কোলে নেওয়ার পর আমার ভেতরে কী যেন ভর করে। বাচ্চাটাকে আমি জড়িয়ে ধরে রাখি কিছুক্ষণ। বাচ্চাটাও কোনো সাড়াশব্দ না করে চুপ করে ছিল। যদি আমার শ্বশুর এসে দেখে ফেলেন অথবা শাশুড়ি ঘুম থেকে উঠে যান, সম্ভবত এই ভয়ে বাচ্চার মা বারবার তাড়া দিচ্ছিল। বাচ্চাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেব, এমন সময় হঠাৎ মনে হলো, বাচ্চাকে ফিরিয়ে দিলে আর যদি না পাই। মনে হলো বাচ্চাকে নিয়ে দৌড়ে যদি পালিয়ে যেতে পারি, বাচ্চার জন্য তার মা–ও চলে আসবে। মা-ছেলে দুজনকেই পেয়ে যাব। এটা মনে হওয়ার পর একমুহূর্ত আর কিছু না ভেবে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম অন্ধকারে।

‘কিন্তু পারিনি। বাচ্চার মা সম্ভবত ভেবেছিল, বাচ্চাটাকে বোধ হয় চুরি করে একেবারে নিয়ে যাচ্ছি। চোর চোর করে পেছনে পেছনে বাচ্চার মা দৌড়াতে শুরু করল। দৌড়ে বেশি দূর পালাতে পারলাম না। চারপাশের লোকজন ঘিরে ফেলল আমাকে। অন্ধকারে চিনে ওঠার আগেই সবাই পিটিয়ে আধমরা করে ফেলল। আমার শ্বশুর এসে পুলিশ ডেকে আমাকে থানায় ঢুকিয়ে দিলেন।’

ঘটনাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য সবাই নির্বাক হয়ে গেলেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে এত ভালোবাসা থাকার পরও ভুল–বোঝাবুঝির কারণে কত দিন তাঁরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসআই বললেন, ‘পুলিশের চাকরি করি ২০ বছর। এ রকম কাহিনি আজ প্রথম শুনলাম। নিজের সন্তান চুরির অপরাধে পিতার হাজতবাস। বিচিত্র দুনিয়া।’

রুমের বাইরে বাচ্চাটাকে নিয়ে কে একজন হাঁটাহাঁটি করছিলেন। বাচ্চার বাবা বলল, ‘স্যার, এখন তো আপনি আছেন, যদি ব্যবস্থা করেন, বাচ্চাটাকে একটু কোলে নেব। আপনার সামনে তো আর দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারব না।’

এসআই আবারও হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘যান যান, কোলে নিয়ে কতক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেন। ততক্ষণে আমরা অঙ্গীকারের কাগজপত্রগুলো রেডি করে ফেলি।’