ছোট করা হবে যমুনা নদী, সাবধানতার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

জামালপুরে যমুনা নদী
ফাইল ছবি

যমুনা নদীকে ছোট করতে চায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আপাতত দেশের দুটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে গ্রোয়েন বাঁধ দিয়ে নদী ছোট করা হবে।

যমুনা নদীকে ছোট করার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে পাউবো বলছে, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদী চওড়া হচ্ছে। নদী কোথাও কোথাও ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত হচ্ছে। এতে নদীভাঙন বাড়ছে।

পাউবো মনে করে, এত চওড়া নদীর প্রয়োজন নেই। এটি সংকুচিত করে সাড়ে ৬ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হবে।

যমুনা নদী ছোট করলে দুটি সুফল পাওয়ার কথা বলছে পাউবো। একটি হলো, নদীর ভাঙন কমবে। অন্যটি বিপুল পরিমাণে ভূমি পুনরুদ্ধার করা যাবে।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীকে ছোট করার চিন্তা নির্বুদ্ধিতার। যাঁদের মাথা থেকে এসব চিন্তা আসে, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কোনো যুক্তিতেই যমুনাকে সংকুচিত করা যাবে না। এটি বিশ্বে এক অনন্য নদী। এ নদীকে নিয়ে যেকোনো ধরনের পরীক্ষা যেন সাবধানে করা হয়।

তবে বিস্তারিত সমীক্ষা না করে গ্রোয়েন প্রযুক্তির প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। নদী সংকুচিত করার বিরোধিতা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতও।

নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীকে ছোট করার চিন্তা নির্বুদ্ধিতার। যাঁদের মাথা থেকে এসব চিন্তা আসে, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কোনো যুক্তিতেই যমুনাকে সংকুচিত করা যাবে না। এটি বিশ্বে এক অনন্য নদী। এ নদীকে নিয়ে যেকোনো ধরনের পরীক্ষা যেন সাবধানে করা হয়।

২০১৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে নৌচুক্তি (প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড) সই হয়েছিল, সেখানে যমুনাকে ভারতের ট্রানজিটের কাজে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে কুড়িগ্রামের দইখাওয়া নৌপথ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার কথা।

যমুনার মতো নদী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এটি একটি অনন্য নদী। একে অন্য কোনো নদীর সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। এই নদীকে নিয়ে নড়াচড়া করার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সাবধান থাকা উচিত।
আইনুন নিশাত, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক

যমুনাকে ছোট করার বিষয় সামনে এসেছে পাউবোর নেওয়া একটি প্রকল্পকে কেন্দ্র করে। ‘যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৮৯৬ কোটি টাকা। বাকি ২১৩ কোটি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেবে। এ বছর অনুমোদন মিললে ২০২৬ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চায় পাউবো।

নদী ছোট করা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা

‘যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা’ প্রকল্পটির ওপর গত ৬ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নদীকে ছোট করা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়।

এতে বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। ভূগর্ভস্থ পানি, কৃষি, মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সাইফুল ইসলাম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক

সভায় পরিকল্পনা কমিশনের পানিসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এম সাইদুজ্জামান বলেন, গ্রোয়েন বাঁধ প্রযুক্তির মাধ্যমে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনার কথা বলা হচ্ছে। যথাযথ সমীক্ষা ছাড়া বিশ্বব্যাংকের ঋণে এ ধরনের পরীক্ষামূলক প্রকল্প নেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তখন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রেজাউল মোস্তফা কামাল বলেন, যমুনা নদীর প্রশস্ততা প্রতিবছর বাড়ছে। এটি কমাতে হলে গ্রোয়েন প্রযুক্তি বসানো প্রয়োজন।

বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের সেচ শাখার উপসচিব সামছুল ইসলাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, যমুনা নদীকে সংকুচিত করার ধারণা ঠিক নয়। ২০২১ সালে একটি কর্মশালায় আইনুন নিশাত বলেছিলেন, যমুনা নদীর যে বৈশিষ্ট্য, তাতে গ্রোয়েন প্রযুক্তি অনুপযুক্ত। টপ ব্লকড পারমিয়েবল গ্রোয়েন (টিবিপিজি) প্রযুক্তি দিয়ে নদী সংকুচিত করার প্রস্তাবে আইনুন নিশাতের বিরোধিতার বিষয়টি তুলে ধরেন উপসচিব।

আন্তমন্ত্রণালয় সভায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শেখ শরীফ উদ্দিন বলেন, যমুনা নদীতে পলি পড়ার হার অত্যন্ত বেশি। এই নদীতে শুধু ড্রেজিং করে নাব্যতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। তবে নদীর প্রশস্ততা কমিয়ে আনলে নাব্যতা রক্ষা করা সহজ হবে।

এ সময় পরিকল্পনা কমিশনের সেচ শাখার যুগ্ম সচিব এনামুল হক যমুনায় পলি পড়ার হার কেমন ও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো সমীক্ষা আছে কি না, জানতে চান। এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, দুই জায়গায় গ্রোয়েন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে নদীতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, যমুনায় কীভাবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে—এসব বিষয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হবে পাউবোকে।

যমুনাকে ঘিরে পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রবীন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষা মৌসুমে কোথাও কোথাও নদীর প্রশস্ততা ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার হয়ে যায়। নদীভাঙন রোধে গ্রোয়েন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান তাঁরা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

নদী ছোট করার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, শতবর্ষী পরিকল্পনায় (ডেলটা প্ল্যান) যমুনাকে সাড়ে ছয় কিলোমিটারে নামিয়ে আনার কথা বলা আছে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। নদী ছোট করতে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে দুটি জায়গায় করা হবে। এটি সফল হলে পরে অন্য জায়গায় করা হবে।

যমুনাকে ছোট করার পরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘যমুনার মতো নদী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এটি একটি অনন্য নদী। এই নদী নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কী নিয়ে সামনে এগোচ্ছে, তার বিস্তারিত আমার জানা নেই। তবে এই নদীকে অন্য কোনো নদীর সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। এই নদীকে নিয়ে নড়াচড়া করার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সাবধান থাকা উচিত।’

প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব

যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এটি পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, এমন অনেক বিষয় দরকার নেই; সেটিও প্রকল্পে ঢোকানো হয়েছে। সেগুলো বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।

যেমন ফরিদপুরে একটি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট থাকার পরও দেশে আরেকটি আন্তর্জাতিক নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রস্তাব করেছে পাউবো। এটি নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৩১ কোটি টাকা। কেন আরেকটি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট বানানোর প্রয়োজন হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কমিশন। পরে তা বাদ দিতে বলা হয়।

প্রকল্পের আওতায় যমুনা নদীতে প্রতি কিলোমিটার গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণে খরচ ধরা হয় ৭৫ কোটি টাকা। অথচ সমজাতীয় একটি প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণে খরচ হয় ২৮ কোটি টাকা। দুটি কাজে খরচের বিশাল পার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। এখানেও ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই প্রকল্পের আওতায় শুধু পরামর্শক ফি বাবদ ২৬৯ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। পাউবোর এত বিশেষজ্ঞ থাকার পরও কেন পরামর্শকের পেছনে এত টাকা খরচ করতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কমিশন। এ খাতেও খরচ কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। এসব বিষয় সংশোধন করে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে রবীন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের কারিগরি কাজে পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। তবু যেহেতু পরিকল্পনা কমিশন থেকে খরচ কমাতে বলা হয়েছে, আমরা তা নিয়ে কাজ করছি। আর আন্তর্জাতিক নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে যমুনা নদীকে সংকুচিত করা কিছুতেই ঠিক হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এতে বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। ভূগর্ভস্থ পানি, কৃষি, মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।