গদিঘরের সেই ইফতার

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

আমি লিখছি ১৯৯০-এর দশকের কথা। আমাদের দাদার বাড়ি ছিল চরে। নাম চর লক্ষ্মীদিয়া। পড়েছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায়। তারপরই চর ভেলামারী। এরপর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পেরোলেই এক কালের প্রমত্ত পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রহ্মপুত্রের ওপারে ত্রিশালের ঐতিহ্যবাহী এলাকা, বালিপাড়া বাজার। আগে এর নাম ছিল রাম অমৃতগঞ্জ।

বালিপাড়া তখন প্রকৃত অর্থেই গঞ্জ। সেখানে তখন থেকেই ছিল রেলস্টেশন, বাস স্টপেজ আর ফেরিঘাট। আশপাশের অনেক ছোট ছোট বাজার থেকে মহাজনেরা পাইকারি জিনিসপত্র কিনতে বালিপাড়া বাজারেই আসতেন।

সে সময়ে একটা চল ছিল, বালিপাড়া বাজারে চরের সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারের একটুকরা জায়গা থাকতে হবে। আমাদের দাদারও ছিল। আব্বা ১৯৯০-এর দশকে বালিপাড়ায় বাড়ি করেন। আমরা গ্রাম ছেড়ে গঞ্জে চলে যাই। গ্রামের দুরন্ত বাল্যকালের স্মৃতি এড়িয়ে গঞ্জে গিয়ে খাপ খাওয়ানো ছিল কঠিন। তবে রোজায় আমার সেই অভাব কেটে যায় গদিঘরের ইফতারের কারণে।

লক্ষ্মীদিয়া চরের জীবনযাত্রা ছিল কৃষিনির্ভর। দাদি বিভিন্ন উৎসবের জন্য বিভিন্ন রকম ধানের আবদার করতেন। সে অনুসারে জমিতে আবাদ হতো নানা জাতের ধান। ইফতারির জন্য মুড়ি ছিল অত্যাবশ্যক। দাদি রোজার আগে নিজ হাতে ভাজতেন মালা ধানের মুড়ি। গোটা গোটা হলদেটে-লালচে মুড়ি। সেই মুড়ি শুধু মরিচ আর শর্ষের তেল দিয়ে মেখে তৈরি হতো আমাদের ইফতারি। ভেজানো চিড়া আর কলা থাকত মাঝেমধ্যে; না হয় কোনো সালুন দিয়ে ভাত। সেই সময়ে শুধু ওই কুড়মুড়ে মুড়িই ছিল অমৃত।

বাজারে তৈরি ইফতারির সঙ্গে প্রথম পরিচয় হলো বালিপাড়ায় আসার পর—মুড়ির সঙ্গে ছোলা, পেঁয়াজু, বুন্দিয়া, বেগুনি আর জিলাপি। আমার মনে হয়, বালিপাড়ার ইফতার যে আমার কাছে প্রিয় ছিল, তা শুধু খাবারের বৈচিত্র্যের জন্যই নয়, মানুষের বৈচিত্র্যের জন্যও।

আমাদের গদিঘরটা ছিল গোদারাঘাট রোডে। চর থেকে যাঁরাই আসতেন, মূল বালিপাড়া বাজারে ঢোকার আগে আমাদের গদিঘরের সামনে দিয়ে যেতে হতো। সেকালে বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও আর সিনেমা হল। তাই দিনের কাজ সেরে যুবকেরা প্রায় সবাই বাজারে চলে আসত। সময় কাটাত চায়ের স্টলে। রোজাও সেই দিনলিপিতে কোনো পরিবর্তন ছিল না। বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সবাই বালিপাড়ায়। আর আমাদের মতো যাঁরা চর থেকে বালিপাড়ায় এসেছেন আর বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত, ইফতার করত তাঁদের গদিঘরে।

আমরা ছিলাম ইফতার আয়োজকের ভূমিকায়। আমাদের বাসা ছিল গদিঘরের পেছনেই। সেই সুবাদে আয়োজক হিসেবে আমাদের বাসার অবদান ছিল একটা বড় গামলা, ছোট এক কলস পানি, মালা ধানের মুড়ি, শর্ষের তেল, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচকুচির সরবরাহ। বাকি ইফতারি আব্বা দোকান থেকে কিনে আনতেন।

ইফতারি তৈরির বিভিন্ন কাজ করতে হতো অংশগ্রহণকারীদের। এখানে আবার ছিল দুই দল। একদল নিয়মিত ইফতার করতেন। আবার আরেক দল করতেন শুধু হাটের দিনগুলোতে, রবি আর বুধবার। যাঁরা নিয়মিত ইফতার করতেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন শাহেদ আলী ভাই আর মোতালেব ভাই। মোতালেব ভাই ইফতারের সামগ্রীগুলো ভেঙে ভেঙে গামলার এক পাশে সাজিয়ে রাখতেন। আব্বা আর শাহেদ আলী ভাই শেষে মাখানোর দায়িত্ব পালন করতেন।

এই গদিঘরের ইফতারির মূল আকর্ষণ ছিল মানুষ। তাঁরা সবাই কোনো না কোনোভাবে আমাদের পরিচিত। ইফতারে আসার সময় তাঁরাও হাতে করে নিয়ে আসতেন একটু ছোলা, একটু মুড়ি, পেঁয়াজু বা বুন্দিয়া। যাঁরা হাটের দিন আসতেন, তাঁরা নিয়ে আসতেন টমেটো, কাঁচা মরিচ, কোনো কোনো দিন ক্ষীরা বা শসার পোঁটলা। আমার হাতে ধরিয়ে দিতেন, যেন বাসা থেকে ধুয়ে কেটে নিয়ে আসি। সবার একটাই আগ্রহ, ইফতারিটা যেন আরও সুস্বাদু আর পরিপূর্ণ হয়। গোদারাঘাটের সামনে রাস্তা থাকায় সবাই নিশ্চিত করতেন, ঘাটে ইফতারের সময় নৌকা ভিড়লেও যেন সবাই ‘ইস্তারি’ (ইফতারি) খুলতে পারেন।

আমার জীবনে গদিঘরের ইফতারির বড় ভূমিকা আছে বলেই বিশ্বাস করি। সেই ছোট্ট গদিটায় অনেক রকমের মানুষ আসতেন, আলোচনা করতেন তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে। সেখানে আসতেন মুক্তিযোদ্ধা জব্বার দাদা, আমাদের এলাকার অনেক শিক্ষক (তাঁদের অনেকে সিলেটে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াতেন, ছুটি হলে আসতেন), যাঁরা ঢাকায় চাকরি করতেন তাঁরা!

বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সেই প্রথম শুনেছিলাম ইফতারে। এক পুলিশ কর্মকর্তা কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা। এ রকম হরেক অভিজ্ঞতা দাগ কেটেছিল ছোট্ট আমার মনে। আর তৈরি করেছিল এক নতুন ভাবনার আকাশ। সেই আকাশেই আমি এখনো উড়ছি!