ভুয়া পাঠাগারের নামে যেত সরকারি বরাদ্দ

  • দেশে তালিকাভুক্ত বেসরকারি পাঠাগার আছে প্রায় ১,৩০০টি।

  • ৫৪টি পরিদর্শন করে ১৯টি ভুয়া পাঠাগার পেয়েছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।

পাঠাগার কিংবা বই, কোনোটিরই অস্তিত্ব নেই; আছে শুধু সাইনবোর্ড। কোনো কোনো পাঠাগার আবার কারোর বসার ঘরের একটি তাকেই সীমাবদ্ধ। বেসরকারি এমন অসংখ্য পাঠাগারের নামে বছর বছর সরকারি বরাদ্দের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সরকারি অনুদান পাওয়া তালিকাভুক্ত পাঠাগারের মধ্যে দেশের আট জেলায় ৫৪টি পাঠাগার পরিদর্শন করেছে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। এর মধ্যে ১৯টিরই কোনো অস্তিত্ব পায়নি তারা।

মন্ত্রী ও সচিবের ২০% অনুদানের কোটায় খরচ হয়েছে পৌনে ১ কোটি টাকা। কোনো কোনো পাঠাগারের অস্তিত্ব শুধু সাইনবোর্ডে।

সারা দেশে তালিকাভুক্ত বেসরকারি পাঠাগার আছে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি। এর মধ্যে গত অর্থবছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক অনুদান পাওয়া বেসরকারি পাঠাগারের সংখ্যা ৯২৩। এই সোয়া ৯০০ পাঠাগারের মধ্যে ৫৪টি পরিদর্শন করে ১৯টি ভুয়া পাঠাগার পাওয়া গেছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সন্দেহজনক পাঠাগারগুলো পরিদর্শন করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ তথ্য জানায়।

সাইনবোর্ডসর্বস্ব পাঠাগার

টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, জয়পুরহাট, নড়াইল, ঝিনাইদহ ও বরিশালে তালিকাভুক্ত বেসরকারি পাঠাগারের সংখ্যা প্রায় ৩০০। এর মধ্যে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে সিয়াম পাঠাগারের আছে শুধু একটি সাইনবোর্ড। কিন্তু গত অর্থবছর পাঠাগারটি বিশেষ কোটায় বরাদ্দ পেয়েছে দুই লাখ টাকা। সিয়াম পাঠাগারকে ছাপিয়ে গেছে কক্সবাজারের মহেশখালীর আহমদ হোছাইন গ্রন্থাগার। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মকর্তারা সরেজমিনে এই পাঠাগারের কোনো অস্তিত্বই পাননি। পাঠাগারের ঠিকানায় মহেশখালীর কালারমারছড়ার কথা উল্লেখ আছে। তবে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা এমন কোনো পাঠাগারের নাম কখনো শোনেননি। এটিও বিশেষ কোটায় গত অর্থবছর অনুদান পেয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

পাঠাগার নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতা আছে। অনুদানের নীতিমালা আছে। কিন্তু পাঠাগার নির্বাচনের নীতিমালা নেই। একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত সব পাঠাগারের প্রতিদিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে।
আফসানা বেগম, পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মালঞ্চা গণপাঠাগার ও বিজ্ঞান ক্লাব গত অর্থবছরে পেয়েছে দুই লাখ টাকার অনুদান। সরেজমিনে জাগীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কর্মকর্তারা দেখেছেন, একটি বেসরকারি সংস্থার বসার ঘরের একটি তাকই হচ্ছে ওই পাঠগার। যেখানে কোনো কালে পাঠের ব্যবস্থা ছিল না। জয়পুরহাটে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তালিকাভুক্ত সন্দেহজনক ১৬টি পাঠাগার পরিদর্শন করেন তাঁরা। এর মধ্যে ১০টি পাঠাগারই ভুয়া পাওয়া গেছে।

ময়মনসিংহের বিদ্যাগঞ্জের সাজেদা-কাশেম গণগ্রন্থাগার এবং সদরের অন্যচিত্র মডেল পাঠাগার দুটির নিবন্ধন রেবেকা সুলতানার নামে। গত অর্থবছর এ দুই পাঠাগার বিশেষ কোটায় পেয়েছে আট লাখ টাকা বরাদ্দ। পাঠাগার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উপগ্রন্থাগারিক মো. রাসেল রানা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাজেদা-কাশেম গণগ্রন্থাগারটি বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি কলেজের শ্রেণিকক্ষে অবস্থিত। যেখানে বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপনের জন্য বিগত সরকারের আমলে দেওয়া বইগুলো ছাড়া আর কোনো বই নেই। এদিকে একই ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত অন্যচিত্র মডেল পাঠাগারটি বেসরকারি সংস্থার অংশ, যেটি মূলত কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখানে কোনো বই নেই।’

রেবেকা সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিত্যক্ত জায়গায় নয়, সাজেদা-কাশেম গণগ্রন্থাগারের জন্যই ওই স্থাপনা তৈরি হয়েছে। অন্যচিত্র মডেল পাঠাগারে উইপোকা ধরে অনেক বই নষ্ট করেছে। অনুদানের বিষয়ে রেবেকা সুলতানা বলেন, তিনি ২০১৯ সালে পাঠাগার দুটি শুরুর পর প্রথম দফায় প্রতিটির জন্য এক লাখ টাকা করে, দ্বিতীয়বার ৫০ হাজার করে এবং সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দুই পাঠাগারের জন্য চার লাখ করে অনুদান পেয়েছেন। মানুষকে বই পড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও সংগতি থাকে না বলে অনুদান চেয়েছিলেন বলে দাবি করেন তিনি।

সারা দেশে তালিকাভুক্ত বেসরকারি পাঠাগার আছে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি। এর মধ্যে গত অর্থবছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক অনুদান পাওয়া বেসরকারি পাঠাগারের সংখ্যা ৯২৩।

মন্ত্রী ও সচিবের ২০% কোটা

‘বেসরকারি গ্রন্থাগারে অনুদান বরাদ্দ এবং বই নির্বাচন–সংক্রান্ত নীতিমালা-২০১৪’–এর অনুদান–বণ্টন নীতি অনুযায়ী, ‘বার্ষিক মোট বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে ২০ শতাংশ সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী ও সচিবের বিশেষ বিবেচনায় সরাসরি মঞ্জুরি প্রদানের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এ সংরক্ষিত অর্থ থেকে জনস্বার্থে বরাদ্দ দেওয়া যাবে।’

গত অর্থবছরে এই ২০ শতাংশ কোটা থেকে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৭৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মোট ৩৪টি বেসরকারি পাঠাগারের জন্য এই অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ১০ লাখ টাকা পেয়েছে মাদারীপুরের শিবচরে অবস্থিত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী স্মৃতি পাঠাগার। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংদস্য ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিক্সন চৌধুরীর বাবা।

তালিকাভুক্ত বেসরকারি পাঠাগারগুলো ক, খ ও গ—এই তিন শ্রেণির হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ‘বেসরকারি গ্রন্থাগারে অনুদান বরাদ্দ এবং বই নির্বাচনসংক্রান্ত নীতিমালা-২০১৪’ অনুযায়ী, ক শ্রেণির পাঠাগারের অন্তত ৩ হাজার বই এবং গড়ে মাসে অন্তত ৩০০ জন পাঠকের উপস্থিতি থাকতে হবে। খ শ্রেণির জন্য দেড় থেকে তিন হাজার বই এবং মাসে ২০০ থেকে ৩০০ জন পাঠকের উপস্থিতি এবং গ শ্রেণির জন্য বইয়ের সংখ্যা ৫০০ থেকে ১ হাজার হতে হবে এবং পাঠকের সংখ্যা প্রতি মাসে ২০০ জন হতে হবে। নীতিমালা অনুসারে বেসরকারি পাঠাগারের জন্য প্রতিবছরের বরাদ্দের ২০ শতাংশ থাকে মন্ত্রী ও সচিবের হাতে।

সোয়া ৯০০ পাঠাগারের মধ্যে ৫৪টি পরিদর্শন করে ১৯টি ভুয়া পাঠাগার পাওয়া গেছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সন্দেহজনক পাঠাগারগুলো পরিদর্শন করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ তথ্য জানায়।

প্রতিটি শ্রেণির জন্য বরাদ্দ অর্থের অর্ধেক টাকা পরিচালন ব্যয় এবং বাকি অর্ধেক টাকার বই দেওয়া হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে। বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে এই অর্থ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। তবে দেশের বেসরকারি পাঠাগারগুলোকে তালিকাভুক্ত করে অনুদানের ক্ষমতা আছে গণগ্রন্থাগার এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের।

জানতে চাইলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাঠাগার নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতা আছে। অনুদানের নীতিমালা আছে, কিন্তু পাঠাগার নির্বাচনের নীতিমালা নেই। একটি সফটওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে তালিকাভুক্ত সব পাঠাগারের প্রতিদিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করা সম্ভব হবে। পাঠাগার হিসেবে তালিকাভুক্তির নীতিমালায় সংশোধন করা হচ্ছে।’