কল্পনা ও প্রকাশে বাংলা ভাষা

মাসউদ আহমাদ

ভাষা কেবল মানুষের কথা বলার মাধ্যমই নয়, মনের অনুভূতির প্রকাশ ও দাবি আদায়ের হাতিয়ারও। বাংলাদেশে নানা ধর্ম ও জাতির বাস, কিন্তু এখানে প্রধানত বাংলা ভাষাতেই বেশির ভাগ মানুষ কথা বলেন। ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের আছে এক অকৃত্রিম আবেগ ও ভালোবাসার সৌধ। আত্মত্যাগ ও লড়াইয়ের ইতিহাস।

রক্ত ও জীবন দেওয়ার ঘটনা। বাংলা ভাষার সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন, কর্মব্যস্ততা ও ভাবনা মিলেমিশে আছে। আমাদের শিল্প-সাহিত্য-গান, সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য, আমাদের নিজস্বতা ও গৌরবে ভাষা নানাভাবে জুড়ে আছে।

পূর্ব বাংলার মানুষ আগে থেকেই বাংলায় কথা বলতেন। বাংলা তাঁদের শুধু মাতৃভাষা নয়, এ ভাষাতে কথা শিখে বড় হয়েছেন। প্রতিদিনের জীবনযাপনেও বাংলা ব্যবহার করেন। মায়ের মতো ভাষার জন্য গভীর মমতা ও টান অবিচ্ছেদ্য। পূর্ব বাংলা যেহেতু পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে কারণে রাষ্ট্রের সমস্ত দাপ্তরিক কাজ, ভাষা ও নির্দেশনা উর্দুতে পরিচালিত হতো।

পূর্ব বাংলার জন্য এটা ছিল অস্বস্তি, অপমান ও বিপদের। কেননা ভাষার মধ্য দিয়ে এমন সব মারপ্যাঁচ ও হুলিয়া জারি করা হতো, প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হতো। এই বাস্তবতায় ক্রমেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিটি অনিবার্য হয়ে ওঠে।

এই জনপদে নানা ভাষার মানুষের বাস, কিন্তু বাংলায় কথা বলার মানুষের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। এখানকার মানুষকে রাষ্ট্রের কাজে পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে চেপে রেখে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। ধোপে টেকেনি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। পরে এই প্রচেষ্টাই মুক্তিযুদ্ধের ভিত গড়ে দেয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি সেই অবিস্মরণীয় দিন, পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য পৃথিবীব্যাপী মানুষের যুগ যুগ ধরে যে সংগ্রাম ও লড়াই, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন তাতে যোগ করেছে এক নতুন মাত্রার চেতনা ও বিস্ময়।

একুশে ফেব্রুয়ারি ও ভাষা আন্দোলনের চেতনা আমরা গভীরভাবে অনুভব করি, বিশ্বাস করি এবং নানাভাবে তা সমুন্নত রাখতে চেষ্টা করি। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির প্রথম সকালে যে প্রভাতফেরি হয়, মাসব্যাপী বইমেলার উৎসব হয়, এসব কেবল উৎসব নয়; এর সঙ্গে আমাদের প্রাণের আবেগ, আত্মত্যাগ ও ঋণ স্বীকারের যোগ আছে।

খালি পায়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নেওয়া ও শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার দৃশ্য দূর থেকে দেখলে মনে হবে আনুষ্ঠানিকতা। প্রকৃতপক্ষে এর সঙ্গে মিশে আছে বাঙালির আত্মত্যাগ, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস। প্রভাতফেরি শেষে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া মানে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো। ঋণ স্বীকার করা। কেননা তাঁরা আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, যেন ভুলে না যাই।

আমার প্রতিদিনের কাজ ও ভাবনাকে ভাষা আন্দোলন ও একুশের চেতনা নানাভাবে প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করে। আমাদের কল্পনা ও প্রকাশ, বইপড়া, কথা বলা এবং মানুষের কথা শোনা—সবকিছুতেই বাংলা ভাষা মিশে আছে। আলাদাভাবে ভেবে, অনুবাদ করে কী প্রতিক্রিয়া দেব, ভাবতে হয় না। সরাসরি মনের ভাবনা ও অভিপ্রায় বাংলায় প্রকাশ করতে পারি। বাংলাদেশি হিসেবে এটা আমাদের জন্য আনন্দের, গর্বের এবং ঋণের। মহান ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

  • লেখক: কথাসাহিত্যিক।