কক্সবাজারে ৮৫টি অবৈধ ইটভাটায় পুড়ছে বনের কাঠ

কক্সবাজারের চকরিয়ার মানিকপুর-সুরাজপুর ইউনিয়নের ফাইতং মৌজার সংরক্ষিত বনে নির্মিত হয়েছে এই অবৈধ ইটভাটা। ১৭ মার্চ দুপুরেছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ৮৫টি ইটভাটায় প্রতিদিন উৎপাদিত হচ্ছে ১৫ লাখের বেশি ইট। এর মধ্যে ৩৩টি ইটভাটার অবস্থান সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে। অধিকাংশ ভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট উৎপাদন চললেও আইনি জটিলতায় এসব উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। এর ফলে বন উজাড়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে।

জেলা প্রশাসন, বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার টেকনাফ, রামু, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, পেকুয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায় ইটভাটা রয়েছে ১০৮টি। এর মধ্যে ৩৩টি ইটভাটা নির্মিত হয়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৩ কিলোমিটারের মধ্যে। অপর ৫৪টি ইটভাটা বিভিন্ন গ্রামে তৈরি হলেও এসবের বিপরীতেও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা’ কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, কৃষিজমির টপ সয়েল, পাহাড় ও টিলার মাটি দিয়ে ৬০টির বেশি ভাটায় দৈনিক ১৫ থেকে ২০ লাখ ইট উৎপাদিত হচ্ছে। ৭ থেকে ১৬ বছর ধরে এসব ভাটায় অবৈধভাবে ইট উৎপাদন চললেও ঠেকানো যাচ্ছে না।

২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন অনুযায়ী, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সীমারেখা থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ। আইনে বলা আছে, সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষিজমিতে ইটভাটা করা যাবে না। ইট উৎপাদনের জন্য কৃষিজমি, পাহাড় ও টিলা থেকে মাটি কেটে কাঁচামাল এবং জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহারও নিষিদ্ধ।

এক মৌজায় ৩৬ ইটভাটা

কক্সবাজার শহর থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার মানিকপুর-সুরাজপুর ইউনিয়নের ফাইতং মৌজার সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৫ মার্চ ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, কাঠ পুড়িয়ে ভাটাগুলোতে ইট তৈরি করা হচ্ছে।

চকরিয়ার বানিয়ারছড়া স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে গেছে পিচঢালা ফাইতং সড়ক। এ সড়কে ঢুকতেই নজরে পড়ে সবুজ গাছপালা ধুলায় ধূসর। ছয় কিলোমিটার পথে চোখে পড়ে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের ফাইতং বনাঞ্চলের ভেতরে তৈরি হয়েছে ১০টির বেশি ইটভাটা। দূরের বনাঞ্চলে দেখা গেছে আরও ১০-১২টি ভাটা। সব কটির চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট।

ফাইতং-গজালিয়া সড়কের পাশে এফএসি নামের একটি ইটভাটা। প্রায় ১০ একরের মতো পাহাড় কেটে এই ভাটায় বসানো হয়েছে চিমনি। পাশেই খননযন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে কাটা হচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড় কাটা মাটি ভিজিয়ে কাঁচা ইট বানাতে ব্যস্ত ২৫-৩০ শ্রমিক, চিমনির আশপাশে কাঠের স্তূপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, সংরক্ষিত বন থেকে কেটে এসব কাঠ ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। ভাটার মালিক চকরিয়ার লক্ষ্যারচরের ফরিদুল আলম। সংরক্ষিত বনে ইটভাটা তৈরি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইটভাটার বিপরীতে লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় লাইসেন্স পাওয়া যাচ্ছে না।

আইনি জটিলতায় উচ্ছেদ কার্যক্রম

রামু উপজেলার কাউয়ারখোপ বাজারের উত্তর পাশে সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ইএম ব্রিকস নামের একটি ভাটায় চলছে ইটের উৎপাদন। ১৭ মার্চ দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড় কাটার মাটি ও ফসলি জমির টপ সয়েল দিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আট-নয় বছর ধরে ভাটায় অবৈধভাবে ইট তৈরি করা হলেও উচ্ছেদ হচ্ছে না।

ভাটার মালিক রামুর বাসিন্দা রফিক উদ্দিন বলেন, বনাঞ্চলের পাশে হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে তিনি ভাটাটি তৈরি করেছেন। কিন্তু ভাটাটি বনাঞ্চলের পাশে হওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিচ্ছে না। কয়লা পুড়িয়ে ভাটায় ইট উৎপাদিত হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও ও রামু উপজেলার অবৈধ ১০টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে ৩৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভাটার চুল্লি ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিছু ভাটার আগুন নিভিয়ে উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে।

কক্সবাজার (উত্তর) বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, বনাঞ্চলের পাশে তৈরি ৩৪টি ইটভাটা উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে। কিন্তু আইনি জটিলতা ও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে অবৈধ ভাটাগুলো উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তবে ভাটাগুলোতে বনাঞ্চলের কাঠ যেন ব্যবহার করা না হয়, সেদিকে সতর্ক নজর রাখা হচ্ছে।