অভিযোগ কমিটি গঠনে পিছিয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

‘যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা। সিরডাপ মিলনায়তান, ঢাকা, ২৪ মার্চছবি: সাজিদ হোসেন

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পিছিয়ে রয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ১৫ বছর পরও সরকারি–বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেনি।

‘যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য উঠে আসে। রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ওই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

২০২১ সালে করা ব্লাস্টের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদিত ১৫৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টি (৬১ শতাংশ) বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০টি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৫৭টি। ৬২টি বিশ্ববিদ্যালয় (৩৯ শতাংশ) কোনো অভিযোগ কমিটি গঠন করেনি। এর আগে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অভিযোগ কমিটি গঠন করেছিল।

মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। ২০২১ সালে করা এ গবেষণার প্রতিবেদন ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়।

গতকাল মতবিনিময় সভায় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ জানান, গত দুই বছরে অভিযোগ কমিটি গঠনের হার বেড়েছে। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি কম হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে বিশ্বজিৎ চন্দ জানান, ৬১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৫টি (৭৩ শতাংশ) এবং ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৯৭টিতে (৯২ শতাংশ) অভিযোগ কমিটি আছে।

মতবিনিময় সভায় উপস্থাপিত ব্লাস্টের গবেষণা প্রতিবেদনটির শিরোনাম হচ্ছে, ‘তথ্য অধিকার আইনের আলোকে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির অভিযোগ ও প্রতিকার’। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তাহমিনা রহমান। মতবিনিময় সভায় তিনি বলেন, যখনই অবন্তিকার (জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী) মতো বড় ঘটনা ঘটে, তখন যৌন নিপীড়নের বিষয়গুলো নতুন করে সামনে আসে। অভিযোগের বিষয়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে অভিযোগ কমিটি করে ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের ঘটনা প্রতিকার করা যেত।

ব্লাস্টের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নমুনায়নের জন্য তথ্য সংগ্রহে ৮টি বিভাগ থেকে ইউজিসি অনুমোদিত ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্বাচন করা হয়। ‘যৌন হয়রানির প্রতিকার ব্যবস্থা’ শিরোনামের গবেষণার জন্য সরকারি-বেসরকারি ২৮টি বিশ্ববিদ্যালয় তথ্য অধিকার আইনে তথ্য দেয়। বাকি ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় আপিল আবেদনের পরও তথ্য দেয়নি। অভিযোগ কমিটিতে সভাপতিসহ অধিকাংশ সদস্য নারী থাকার নির্দেশনা থাকলেও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তা মানেনি। তথ্য দেওয়া ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৮ শতাংশ ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ বাক্স নেই। অভিযোগ রয়েছে, সব অভিযোগ গ্রহণ করা হয় না।

‘যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা: বর্তমান অবস্থা ও বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা। সিরডাপ মিলনায়তান, ঢাকা, ২৪ মার্চ
ছবি: নাজনীন আখতার

গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২৮ বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ কমিটি মোট ৯৯টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। এর মধ্যে কোভিডের সময় অনলাইনে পাওয়া ১৯টি অভিযোগ রয়েছে। সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৯টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বেশি ১৮টি অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে।

যৌন হয়রানির বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য তুলে ধরে মতবিনিময় সভায় বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ হার আরও বেশি, ৮৭ শতাংশ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ–বিদ্রুপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ শতাংশ।

সভায় ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, অনেক অভিযোগ মিথ্যাও প্রমাণিত হয়। তাই অভিযোগ প্রমাণের আগে অভিযোগকারীর পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রকাশ হওয়া উচিত নয়। মিথ্যা অভিযোগের ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান থাকা উচিত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১০ সাল থেকে ইউজিসি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কমিটি গঠনের দিকটি পর্যবেক্ষণে রাখছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহ্‌নাজ হুদা বলেন, রাজনৈতিক দলের কর্মীদের মাধ্যমেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা ঘটে। অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতেও অনেক সময় তারা ক্ষমতা ব্যবহার করে। তাই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার থাকতে হবে।

সভায় সভাপতির বক্তব্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে, যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ নীতিমালা-২০১০ হয়েছে। আইন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে ওই নীতিমালাটিই আইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহ্‌নাজ হুদা বলেন, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার থাকতে হবে।

সভায় আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন্নাহার সিদ্দিকা। স্বাগত বক্তব্য দেন ব্লাস্টের পরিচালক (আইন) মো. বরকত আলী। সভা সঞ্চালনা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলাম।