মাছের শুক্রাণু শত বছর সংরক্ষণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন

রাজধানীর ফার্মগেটের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) মিলনায়তনে এক কর্মশালায় ‘ক্রায়োপ্রিজারভেশন’ এই প্রযুক্তি বিষয়টি তুলে ধরা হয়
ছবি: প্রথম আলো

দেশের মাছের শুক্রাণু শত বছর বা তারও বেশি সময় সংরক্ষণের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এতে মাছের প্রজাতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সম্ভব হবে এবং উৎপাদনও বাড়বে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগ ও যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি অ্যাগ্রিকালচার সেন্টারের অ্যাকুয়াটিক জার্মপ্লাজম অ্যান্ড জেনেটিক রিসোর্সেস সেন্টার যৌথভাবে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এই প্রযুক্তির নাম ‘ক্রায়োপ্রিজারভেশন’। কাতলা, রুই, মৃগেল, সিলভার, বিগহেড ও গ্রাস কার্প—এই ছয় প্রজাতির মাছের ওপর গবেষণা চালিয়ে সাফল্য পেয়েছেন গবেষকেরা।

আজ বুধবার সকালে রাজধানীর ফার্মগেটের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) মিলনায়তনে এক কর্মশালায় এই প্রযুক্তির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। ‘ক্রিওজেনিক স্পার্ম ব্যাংকিং অব ইন্ডিয়ান মেজর কার্পস অ্যান্ড এক্সোটিক কার্পস ফর কমার্শিয়াল সিড প্রোডাকশন অ্যান্ড ব্রুড ব্যাংকিং’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এই প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। এতে অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএইড ও ফিড দ্য ফিউচার ইনোভেশন ল্যাব ফর ফিশ। মৎস্য অধিদপ্তরও এতে সহযোগিতা করেছে।

বাকৃবির ফিশারিজ বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগের অধ্যাপক মো. রফিকুল ইসলাম সরদারের নেতৃত্বে এই গবেষণার সহকারী প্রধান গবেষক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান এবং সদস্য হিসেবে ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক মরিয়ম। আর এই গবেষণাকর্মের পরামর্শ বাকৃবির সাবেক অধ্যাপক মো. ফজলুল আউয়াল মোল্লা। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির অ্যাগ্রিকালচার সেন্টারের অধ্যাপক টেরেন্স টিয়ার্স।

গবেষকেরা বলেন, হালদা ও পদ্মা থেকে কাতলা, রুই ও মৃগেল এবং চীন থেকে সিলভার, বিগহেড ও গ্রাস কার্প মাছের বিশুদ্ধ প্রজাতি আহরণ করা হয়। সেগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয় শুক্রাণু। তারপর সেসব বিশুদ্ধ শুক্রাণু দিয়ে দেশের ময়মনসিংহ, যশোর, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের সরকারি–বেসরকারি হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করা হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ হ্যাচারি যেসব শুক্রাণু থেকে মাছের পোনা উৎপাদন করে, তার চেয়ে এই সংরক্ষিত শুক্রাণু থেকে উৎপাদিত মাছের পোনার বৃদ্ধি বেশি। যেমন সাধারণ হ্যাচারির শুক্রাণুর একটি মৃগেল মাছ যে সময়ে ১০৭ গ্রাম ওজন হয়, একই সময়ে সংরক্ষিত শুক্রাণুর মৃগেল মাছের ওজন হয় ১৪০ গ্রাম।

সাধারণ হ্যাচারিগুলো শুক্রাণু সংগ্রহের জন্য বিশুদ্ধ প্রজাতি পায় না। তাদের ব্রুডগুলো (পুরুষ ও মা মাছ) হয়ে থাকে আন্তপ্রজনন ও সংকরায়ণের শিকার। সে কারণে সাধারণ হ্যাচারিগুলোর মাছের বৃদ্ধি কম।

গবেষকেরা জানান, তরল নাইট্রোজেনে ভেতর মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় যত দিন রাখা যাবে, ততদিনই শুক্রাণু ঠিক থাকবে। বিদেশে এই প্রযুক্তি চালু থাকলেও দেশে এটা প্রথম সফল প্রয়োগ।

অনুষ্ঠানে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন প্রধান গবেষক রফিকুল ইসলাম সরদার। তিনি বলেন, মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিপন্নপ্রায় মাছের প্রজাতি রক্ষায় এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

জানা যায়, বর্তমানে দেশে ১০৩টি সরকারি ও ৯৫৩টি বেসরকারি হ্যাচারি রয়েছে। দেশের চাহিদার প্রায় শতভাগ পোনা এই হ্যাচারিগুলো সরবরাহ করে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসে মাত্র শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ পোনা।

সহকারী প্রধান গবেষক মোহাম্মদ মতিউর রহমান বলেন, হ্যাচারিতে উৎপাদিত পোনা দিয়ে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ হলেও পোনার গুণগতমানের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে মাছ চাষে কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছে না। প্রজাতির বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সম্ভব হলে উৎপাদন আরও বাড়বে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাকৃবির উপাচার্য মো. আবদুল আউয়াল বলেন, এখন অনেক মাছেরই আগের মতো স্বাদ নেই। সংকর হয়ে, আন্তপ্রজনন হয়ে মূল প্রজাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে মূল প্রজাতি টিকে থাকবে বলে আশা করি।

এই গবেষণা প্রকল্প শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে। ২০২৩ সালের মার্চে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ আগামী আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শুক্রাণু সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারকে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন আলোচনায় অংশ নেওয়া কেউ কেউ।

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খ. মাহবুবুল হক বলেন, একটি প্রকল্পের আওতায় দুটি মৎস্য হাব করা হবে। আর দেশে ১০টি সেন্টার করা হবে। সেখানে শুক্রাণু পরীক্ষামূলকভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, এই প্রকল্প আরও চালানো প্রয়োজন। এই প্রযুক্তি যদি মাঠে না যায়, তাহলে এর ফল চাষি ও সরকার পাবে না। এ ক্ষেত্রে মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটকে সম্পৃক্ত করলে তা দ্রুত মাঠপর্যায়ে যাবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দেন বাকৃবির মাৎস্য অনুষদের ডিন মো. আবুল মনসুর। এ সময় আরও বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি অ্যাগ্রিকালচার সেন্টারের পোস্ট ডক্টরেট গবেষক জ্যাক কচ, ফিড দ্য ফিউচার ইনোভেশন ল্যাব ফর ফিশের এশিয়া অঞ্চলের সমন্বয়ক জি এম হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সহযোগী অধ্যাপক মরিয়ম।