‘ছাত্র ও শিশুদের ওপর গুলি দেখে ঘরে থাকতে পারিনি’

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে কারওয়ান বাজার এলাকায় হাতে এক টুকরা টিন নিয়ে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন স্যানিটারি মিস্ত্রি মো. নাসির খান। ৩০ বছর বয়সী এই যুবকের সেই ছবি যেন প্রতিরোধের প্রতীক। ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর আরামবাগের একটি দোকানে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক মাহমুদুল হাসান

প্রথম আলো:

আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন?

মো. নাসির খান: আমার বাসা আরামবাগে। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেই। আমার এই আন্দোলনে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু কয়েকটা সংবাদ আমাকে এলোমেলো করে দেয়। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ীতে একটা বাচ্চাকে গুলি করে নির্মমভাবে মারা হয়। আমার এলাকায় চোখের সামনে আওয়ামী লীগের লোকজন একটি মেয়েকে রড দিয়ে আঘাত করে শরীরে দাগ বসিয়ে দেয়। নটর ডেম কলেজের অনেকগুলো ছাত্রাবাস রাতে তালা দিয়ে দেয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে আক্রমণ করে। এসব ঘটনা দেখে খারাপ লাগে।

মানুষের প্রতি যে অত্যাচার, জুলুম শুরু হয়েছিল, সেটা মেনে নিতে পারছিলাম না। আন্দোলনে বাচ্চারা নেমেছে, নারীরা নেমেছে, শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে। সেখানে রিকশাওয়ালারাও ছিল, আমার মতো বিভিন্ন শ্রেণির মানুষও রাস্তায় নেমেছে। তখন মনে হলো দেশের জন্য আমারও রাস্তায় নামা উচিত। এরপর ২৩ জুলাই থেকে বাড্ডা, শহীদ মিনার, শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটসহ আশপাশের এলাকায় আন্দোলন করেছি। মা বাধা দিতে পারেন বুঝে তাঁকেও আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানাইনি।

প্রথম আলো:

আরামবাগ, মতিঝিল রেখে বাড্ডা, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর এলাকায় গেলেন কেন?

মো. নাসির খান: আমার বাড়ি ঝালকাঠিতে। ২০০৭ সাল থেকে আরামবাগ এলাকায় থাকি। স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে কাজ শুরু করি। কখনো কোনো দলের সঙ্গে রাজনীতি করিনি। তবে এখানে অনেক রাজনৈতিক লোক আছে, তারা আমার পরিচিত। তাদের সামনেই আমি বড় হয়েছি। এ জন্য তাদের কিছু বলতে পারব না। আবার অন্যায়ও সহ্য করতে পারছিলাম না। ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে দেখলে আওয়ামী লীগের ভাইয়েরা আমাকে ধরত। বাসায় গিয়ে মেরে আসত। এ জন্য আরামবাগ-মতিঝিল রেখে অন্য এলাকায় গিয়ে ‘ফাইট’ করতে হয়েছে।

প্রথম আলো:

স্যানিটারি মিস্ত্রির কাজ করে আন্দোলনে যাওয়ার সময় বের করেছেন কীভাবে?

মো. নাসির খান: প্রতিদিন আন্দোলনে গিয়েছি, তা নয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে যখনই সুযোগ পেয়েছি, গিয়েছি। আমি কাজের পাশাপাশি স্যানিটারি কাজের ঠিকাদারিও নিতাম। আমার অধীনে আরও চারজন কাজ করে। অনেক সময় তাদের কাজ দেখিয়ে দিয়ে আমি আন্দোলনে চলে গিয়েছি। কারফিউর কারণে কখনো আবার আন্দোলনের কারণে কাজ বন্ধ থাকত, তখন যেতাম। এভাবেই সময় করে নিয়েছি।

আমি এসএসসি পাস করতে পারিনি, কিন্তু এই ছাত্ররা তো দেশের ভবিষ্যৎ। ২৮ জুলাই যেদিন এলাকায় আমার চোখের সামনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের লোকজন নটর ডেম কলেজের ছাত্রদের ছাত্রাবাস থেকে বের করে পিটিয়েছে, ছোট ছোট পিস্তল দিয়ে গুলি করেছে, তার পর থেকে প্রতিদিন টানা আন্দোলনে গিয়েছি।

প্রথম আলো:

আন্দোলনের মাঠে কী ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন?

মো. নাসির খান: আমাদের কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ ছিল না। আমি এককভাবে সেখানে গিয়েছি। এমন অনেকে আলাদাভাবে আন্দোলনে গিয়েছিল। আমি প্রথম যেদিন বাড্ডায় আন্দোলনে যাই, সেদিন সেখানে আমার পাশে থাকা একজনকে যুবলীগের লোকজন পেছন দিক থেকে বাঁশ দিয়ে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। ওই ব্যক্তিও বিএনপি, জামায়াত-শিবির বা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নয়। আমার মতোই সাধারণ মানুষ। এমন আরও অনেকের ওপর আক্রমণ হয়েছে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকেরা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। কাউকে কোথাও যেতে দিচ্ছিল না। দোকানপাট বন্ধ করে রাখা হয়।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ে এভাবেই প্রতিরোধ গড়ে তোলেন নাসির খান। গত বছরের ৪ আগস্ট
ছবি: আহছান উল্লাহ
প্রথম আলো:

টিন সামনে রেখে গুলির মুখে প্রতিরোধের চিন্তা কীভাবে এল?

মো. নাসির খান: ৪ আগস্ট আমার এলাকার গলির মুখে মুখে আওয়ামী লীগের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে বসেছিল। ব্যারিকেড দিয়ে, ইট ফেলে রাস্তা তখন বন্ধ করে রাখা হয়। পরে কিছু পথ রিকশায়, কিছু পথ হেঁটে শাহবাগে যাই। মোবাইল ফোনের কোনো নেটওয়ার্কও ছিল না। তখন খবর পেলাম বাংলামোটরে আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আমরা রওনা হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের কাছে যাওয়ার পরই কারওয়ান বাজার মোড়ের দিক থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি করা শুরু করে। তাদের কাছে রামদা ছিল। তখন আমার পাশের একজনের মাথায় গুলি লাগে। আমি তাকে রিকশায় তুলে দিই। পরে আর ছেলেটার খবর নিতে পারিনি। সম্ভবত ছেলেটা মারা গেছে।

যখন পাশে একজন গুলিবিদ্ধ হলো, কিছুক্ষণ পর আওয়ামী লীগের লোকজনের সঙ্গে পুলিশও গুলি শুরু করল। আমাদের দিকে একের পর এক রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। কিন্তু আমরা বলেছিলাম, গুলি করুক বা যা–ই করুক আমরা পেছনে যাব না, সামনে এগিয়ে যাব। এরপর সোনারগাঁও হোটেলের পাশ থেকে টিন ছুটিয়ে, দুই টুকরা করে ঢাল বানাই। কেউ কেউ প্লাস্টিকের রোড ডিভাইডার (সড়কে গতিপথ ঠিক করতে ব্যবহৃত হয়), পানির প্লাস্টিকের জার দিয়ে ঢাল বানাল। এরপর আমরা সামনে এগোতে থাকলাম। তখন আওয়ামী লীগের লোকজন ও পুলিশও পিছু হটতে শুরু করে। একপর্যায়ে তাদের আমরা ফার্মগেট পর্যন্ত নিয়ে যাই। এ সময় ফার্মগেট আওয়ামী লীগ-যুবলীগের লোকজনও আমাদের দিকে গুলি করতে থাকে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

এরপর কী হলো?

মো. নাসির খান: আমি তখন সবাইকে পেছনে ফেলে অনেক সামনে চলে যাই। এ সময় আমাদের সামনে থাকা হামলাকারীদের একজন বলছিল, ‘মনির ভাই, টিনের ভেতরে থাকা ওইটারে গুলি করেন। ওরে দেখে অন্যরাও সামনে আসতেছে।’ টিনটার পেছনে দুই–আড়াই ঘণ্টা গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। তারা গুলি করছিল আর আমরা ইটের টুকরা, টাইলস ভেঙে তাদের দিকে ছুড়ে মারছিলাম। তখন মোবাইল ফোন টিনের ওপরে নিয়ে ভিডিও করার চেষ্টা করছিলাম। ৩০ সেকেন্ডের একটা ভিডিও করতে পেরেছিলাম। এর মধ্যেই কপালে, হাতে ও মোবাইল ফোনের পেছনের ক্যামেরায় ছররা গুলি লাগে। সর্বশেষ ফার্মগেটে যখন আমার পাশে একজন গুলিবিদ্ধ হয়, তার রক্তে রাস্তা ভিজে যায়। তখন আমিসহ দুজন তাকে হাতে তুলে নিয়েছিলাম। তখন আর টিনটা ধরে রাখতে পারিনি। এরপর পুলিশ ও আওয়ামী লীগের লোকেরা আবার ঢিল ছোড়ে ও গুলি করতে থাকে। তখন ছেলেটাকে রেখেই আমি হাসপাতালে যাই। একজন রিকশাওয়ালা আমাকে পিজি হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) নিয়ে গিয়েছিলেন। বাইরে থেকে হাসপাতালের ফটক বন্ধ করে লুকিয়ে আমাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। পরে গ্রেপ্তারের ভয়ে হাসপাতালের এক নিরাপত্তারক্ষীর পরামর্শে ব্যান্ডেজ খুলে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরি।

প্রথম আলো:

কারফিউর মধ্যে আন্দোলনে যাওয়া, গুলির মুখে দাঁড়ানোর সাহস হলো কীভাবে?

মো. নাসির খান: আমার মনের মধ্য থেকে ভয়টা চলে গিয়েছিল। পুলিশ বা কেউ ধরলে কী হবে—তা মাথাতেই আসত না। গুলি করলে আমি আহত হব, মরে যাব, এমন সেন্সই ছিল না। আমার আয়ে পরিবার চলে। আমি মারা গেলে পরিবারের কী হবে, তা–ও ভাবনায় আসেনি। আসলে আবু সাঈদ, মুগ্ধ ও ওয়াসিমকে যখন শুধু শুধু গুলি করে মারা হলো, তখন নিজেকে মানুষই মনে হতো না। এসব ভেবে আমাদের লক্ষ্য ছিল সামনে যেতে হবে। এ জন্য আমি যখন এগিয়ে গিয়েছি, আমার পেছনে পেছনে অনেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

আন্দোলনের আগের সময় ও বর্তমান সময়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছেন?

মো. নাসির খান: এখন তো কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি। তখন কি এইভাবে এখানে বসে (আরামবাগের একটি স্যানিটারি দোকান) কথা বলতে পারতাম? এই যে আমার ছবিটা তোলা হলো, আমি জানি না কীভাবে ছবিটা তুলেছে। কারণ, সেখানে কোনো সাংবাদিক দেখিনি। কাউকে ছবি তুলতে দেখলে তখন আমরা ঢিল মারতাম। কারণ, ৫ আগস্ট যে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবে, এটা তো আমরা জানতাম না। যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে যেত, তাহলে এই ছবি দেখলে কি আজ আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেত? এর বাইরে পার্থক্য হলো, আগে এলাকায় যেমন চাঁদাবাজি ছিল, সেটাও কিছুটা কমেছে।

প্রথম আলো:

দেশ নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কী? ভবিষ্যতে কেমন দেশ দেখতে চান?

মো. নাসির খান: সরকার পরিবর্তনে খুব বড় পরিবর্তন আমরা সহজেই পাব না। যারা এখন সরকারে এসেছে, তারা কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাদের সময় দিতে হবে। কারণ, প্রশাসন একেক সময় একেক দলের কথা শোনে, আর ভুক্তভোগী হই আমরা। যদি তারা শুধু দলের কথাই শোনে, তাহলে সাধারণ মানুষ কী করবে? এ জন্য আমি চাই, সরকার যেন দেশটার সবকিছু একটু গুছিয়ে নির্বাচন দিতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেই কাজ করে গেছে, বিএনপি এখন একই কাজ করছে। আওয়ামী লীগকেও তো আমরা ভালোবাসতাম। কুকর্মের কারণে তাদের প্রতি আমাদের মনে ঘৃণা জন্মেছে। একই কাজ যদি বিএনপি বা অন্য দল করে, তখনো কিন্তু মনের মধ্যে একই অবস্থা হবে। এখন দেখছি হামলাকারী আওয়ামী লীগের অনেকে দল পরিবর্তন করে অন্য দলে যোগ দিচ্ছে।

সরকারের কাছে আমার কোনো কিছু চাওয়ার নেই। আমি হাইলাইটসও হতে চাই না। আমি শুধু মন খুলে, বুক ফুলিয়ে কথা বলতে চাই। কথা বলার সময় যেন আমার মনের মধ্যে ভয় না আসে যে আমি কথা বললাম আর অমুক ভাই বা নেতা এসে কিছু বলবে বা জেরা করবে। মানুষ হিসেবে, নাগরিক হিসেবে কি আমার কথা বলার সেই অধিকার নেই?

প্রথম আলো:

আপনাকে ধন্যবাদ।

মো. নাসির খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।