সুযোগ থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী যাচ্ছে কম

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের একটি নির্মাণাধীন অবকাঠামোয় হেঁটে যাচ্ছেন একজন শ্রমিক। ৩০ মে ২০১৬ছবি: রয়টার্স

বিদেশি কর্মীদের জন্য ভালো আয়ের সুযোগ আছে এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রমবাজারে। একজন কর্মী প্রতি মাসে অন্তত দেড় লাখ টাকা আয়ের সুযোগ পান এখানে। দেশটিতে কর্মীর চাহিদাও প্রতিবছর বাড়ছে। তবে সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না। সরকারিভাবে দেশটিতে কয়েক হাজার কর্মী গেলেও বেসরকারি খাতে যাচ্ছেন হাতে গোনা।

চলতি বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ হাজার কর্মী পাঠানোর কোটা পেয়েছিল বাংলাদেশ। সেখানে নভেম্বর পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন খাতে কাজ করতে ৪ হাজার ৫৪০ জন কর্মী গেছেন বলে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যে জানা গেছে। বিদেশে কর্মী পাঠানোর সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) বলছে, এ বছর যেসব কর্মী দক্ষিণ কোরিয়া গেছেন, তাঁদের মধ্যে ৪ হাজার ২০০ জনকে তারাই পাঠিয়েছে। আর বাকি মাত্র ৩৪০ জন পাঠিয়েছে বেসরকারি খাতের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো।

সরকারিভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নেওয়ার পাশাপাশি দেশটির স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে কৃষি খাতে কর্মী নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। এর জন্য ওই দেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কর্মী পাঠানো দেশটির স্থানীয় সরকার বিভাগের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করতে হয়। সবজি বাগান, সবজি বাজারজাতকরণ, শূকর পালনের মতো কাজে এসব কর্মী নেয় দেশটি। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, চীন, ফিলিপাইন, ভারতসহ কয়েকটি দেশ থেকে এসব খাতে কর্মী যাচ্ছে এখন।

বোয়েসেলের মাধ্যমে কোরিয়া যেতে কর্মীদের তেমন বেশি খরচ নেই। বোয়েসেলে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা। আর যেতে উড়োজাহাজভাড়া ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। মাসে বেতন অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত সময় কাজ করলে কেউ কেউ তিন লাখ টাকাও আয় করতে পারেন। থাকা ও খাওয়ার খরচ চালায় কোম্পানি।

বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কৃষি-খামার খাতে প্রচুর কর্মীর চাহিদা আছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। এসব কাজ মূলত খণ্ডকালীন। একজন কর্মী একবার গিয়ে আট মাস থাকতে পারবেন। এরপর তিন মাসের ছুটি কাটিয়ে আবার গিয়ে আট মাস কাজ করতে পারবেন। ছুটিতে আসা-যাওয়ার বিমানভাড়া দেবে নিয়োগকর্তা। মাসে বেতন দেড় লাখ টাকার বেশি। কোরিয়ান ভাষা শেখা ও কারিগরি জ্ঞানের বাধ্যবাধকতা নেই। তাই কর্মীরা বেশি আয়ের আশায় যেতে চান দেশটিতে। তবে এক বছরের নিচে কোনো চাকরির চাহিদাপত্র সত্যায়ন করছে না কোরিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস। তাই আটকে আছে খণ্ডকালীন কাজে কর্মী পাঠানো।

কোরিয়ায় কর্মী পাঠাতে গত ২৬ অক্টোবর প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে রিক্রুটিং এজেন্সি হোপ হিউম্যান রিসোর্সেস। কোরিয়ার কৃষি খাতে বাংলাদেশি কর্মীদের পাঠানোর সুযোগ হাতছাড়া না করার অনুরোধ জানিয়ে এতে বলা হয়, গত দুই বছরে এ খাতে বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মীও পাঠানো যায়নি। কোরিয়ার হামপিয়াং-গুণ স্থানীয় সরকারের সঙ্গে রাজবাড়ির রামকান্তপুর ইউনিয়ন ২০ জন কর্মী পাঠানোর সমঝোতা স্মারক সই করেছে। পর্যায়ক্রমে ২০০ কর্মী পাঠানো যাবে। হোপ হিউম্যান রিসোর্সেস এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর ক্ষমতা দিয়েছে রামকান্তপুর ইউনিয়ন। স্বল্প খরচে বেশি আয়ের দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত করার দাবি জানানো হয় তাদের চিঠিতে।

তবে অভিবাসন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেসরকারি খাত কর্মী পাঠাতে বাড়তি টাকা নিয়ে বাণিজ্য করার চেষ্টা করবে। কোরিয়া পাঠানোর নামে কেউ কেউ প্রতারণাও করতে পারে। কোনোভাবেই কোরিয়ার বাজার নিয়ে ঝুঁকি তৈরি করা যাবে না। তাই ভালো করে যাচাই–বাছাই না করে কাউকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেওয়া উচিত হবে না। তবে দূতাবাস চাইলেই এটি যাচাই–বাছাই করে দেখতে পারে। এতে আরও বেশি কর্মী পাঠানোর সুযোগ তৈরি হবে।

কোরিয়া যাওয়ার প্রক্রিয়াটি পাঁচটি ধাপে শেষ হয়। শুরুতে অনলাইন নিবন্ধন। এরপর লটারি করে বোয়েসেল। বিজয়ীদের কোরিয়ার ভাষাগত দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়। এটি পাস করলে দক্ষতা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এরপর পুলিশের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ভিসার আবেদন করা যায়।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, খণ্ডকালীন কাজে কর্মী পাঠানো সম্ভব। সরকারের সঙ্গে চুক্তি হলে বোয়েসেলের মাধ্যমে পাঠানো সহজ ও নিরাপদ হতো। বেসরকারি খাতে কর্মী পাঠানোর আগে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই করে সত্যায়ন করতে হবে। দূতাবাসকে ইতিমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সত্যায়ন হলেই কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হবে।

আরও কর্মী নেওয়ার ঘোষণা

বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ থেকে প্রতিবছর কর্মী নেয় দক্ষিণ কোরিয়া। বছর শুরুর আগেই তারা কর্মীর চাহিদা ঘোষণা করে। এরপর বছরের শুরুতে ১৬টি দেশের মধ্যে তা ভাগ করে দেয়। এ হিসেবে ২০২৩ সালে ১০ হাজার কর্মী পাঠানোর কোটা পায় বাংলাদেশ। তবে নভেম্বর পর্যন্ত দেশটিতে গেছেন ৪ হাজার ২০০ জন। এ কর্মী পাঠানোর কাজটি করে বোয়েসেল।

বোয়েসেলের মাধ্যমে কোরিয়া যেতে কর্মীদের তেমন বেশি খরচ নেই। বোয়েসেলে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকা। আর যেতে উড়োজাহাজভাড়া ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টাকা। মাসে বেতন অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অতিরিক্ত সময় কাজ করলে কেউ কেউ তিন লাখ টাকাও আয় করতে পারেন। থাকা ও খাওয়ার খরচ চালায় কোম্পানি। এত সুযোগ থাকায় দেশটিতে যেতে আগ্রহী কর্মী অনেক। পাঁচটি ধাপে প্রক্রিয়াটি শেষ হয়। শুরুতে অনলাইন নিবন্ধন। এরপর লটারি করে বোয়েসেল।

বিজয়ীদের কোরিয়ার ভাষাগত দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়। এটি পাস করলে দক্ষতা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা। এরপর পুলিশের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ভিসার আবেদন করা যায়।
এর আগে বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২১ সালে ৫২ হাজার, ২০২২ সালে ৬৯ হাজার এবং ২০২৩ সালে ১ লাখ ২০ হাজার কর্মী গেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। আগামী বছরের জন্য ইতিমধ্যে ১ লাখ ৬৫ হাজার কর্মীর চাহিদা ঘোষণা করেছে কোরিয়া। উৎপাদনশিল্প খাতে ৯৫ হাজার, কৃষি খাতে ১৬ হাজার, নির্মাণশিল্পে ৬ হাজার, মৎস্য খাতে ১০ হাজার, জাহাজশিল্পে ৫ হাজার, সেবা খাতে ১৩ হাজার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী ২০ হাজার। আগামী জানুয়ারিতে কোটা ভাগ করা হবে ১৬ দেশের মধ্যে। বাংলাদেশ এবার ১২ থেকে ১৪ হাজার কর্মী পাঠানোর চাহিদা পেতে পারে। এর পুরোটাই পাঠাবে সরকারি সংস্থা বোয়েসেল।

বোয়েসেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মল্লিক আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়তি কোটা ঘোষণা করে কোরিয়া। আবার ঘোষণা অনুসারে সব সময় কর্মী নিতে পারে না ওরা। ইউরোপে চাহিদা কমায় ওদের শিল্পকারখানায় কাজ কমেছে, তাই বাড়তি কর্মী নেয়নি।