ইয়াহিয়া হিটলারকেও লজ্জা দিয়েছে

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত চারটি পোস্টকার্ড। এগুলো প্রদর্শিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তৃতীয় গ্যালারিতে
ছবি: প্রথম আলো/মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সৌজন্যে

মাটিতে ছড়িয়ে আছে রাশি রাশি মানুষের মাথার খুলি। তার ওপরে বুক টান করে দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী জেনারেল ইয়াহিয়া খান। সঙ্গী হিসেবে আছে অ্যাডলফ হিটলার। তবে আকারে–প্রকারে হিটলারকে ছাড়িয়ে গেছে ইয়াহিয়া। কালি–কলমে আঁকা এই রেখাচিত্রের ওপরে শিরোনাম ‘ইয়াহিয়া হিটলারকেও লজ্জা দিয়েছে’।

লাল-কালো দুইরঙা এই পোস্টকার্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে। ভেনেজুয়েলার একটি পত্রিকা প্রতিবেদন ধরে এই পোস্টকার্ড বাংলাদেশ গণসাধারণতন্ত্র সরকারের জনসংযোগ বিভাগ। এতে লেখা: ‘এই বীভৎস নিধনযজ্ঞ, এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের সামনে অন্য সব নৃশংসতাই ম্লান হয়ে গেছে।/ গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার কলঙ্কময় ইতিহাস খুঁজলে হিটলারের নিধনশিবির অথবা চেঙ্গিস খান বা তৈমুরলঙের নৃশংসতার কাহিনিতেও এরূপ হত্যাকাণ্ডের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে।’ সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে: দ্য রিলিজিয়ন অব কারাকাস, ক্যাথলিক দৈনিক, ভেনেজুয়েলা।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপরে যে বীভৎস গণহত্যা চালিয়েছিল, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে হিটলারের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। এই পোস্টকার্ড বড় করে পোস্টারের আকারে পুনর্মুদ্রণ করে প্রদর্শন করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তৃতীয় গ্যালারিতে।

প্রবাসী সরকারের উদ্যোগে প্রকাশিত এই পোস্টকার্ড, পোস্টার প্রভৃতির নকশার কাজে যুক্ত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী বীরেন সোম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি “আর্ট সেল” করা হয়েছিল। এই আর্ট সেলের কার্যালয় ছিল কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডের একটি নয়তলা ভবনের চতুর্থ তলায়। আর্ট সেলের প্রধান ছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। তাঁর অধীনে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, প্রাণেশ মণ্ডল, নাসির বিশ্বাস ও আমি—এই ছয় শিল্পী কাজ করতাম।’

সেই সময়ের কাজের কথা স্মরণ করেন এই শিল্পী। তিনি বলেন, ‘আমরা মে মাসের দিকে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। প্রথম দিকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পোস্টার করা হতো। আলোচনা করে বিষয়বস্তু ঠিক করে প্রাথমিক নকশা করা হতো। তারপর সেগুলো তথ্য মন্ত্রণালয়ে যেত অনুমোদনের জন্য। অনেক ভাবনা অনুমোদন পেত, কোনোটি পেত না। অনুমোদন পেলে নকশা চূড়ান্ত করে পাঠানো হতো ছাপাখানায়। ছাপার পর প্রবাসী সরকার সেগুলো রণাঙ্গনের মুক্তাঞ্চলে ও বিদেশে পাঠাত। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করত এসব পোস্টার। সম্ভবত ১২টি পোস্টার করা হয়েছিল। এ ছাড়া অনেক প্রচার পুস্তিকারও ডিজাইন করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অক্টোবর-নভেম্বর মাসের দিকে বেশ কিছু পোস্টকার্ড তৈরি করা হয়েছিল।’ তবে পোস্টকার্ডের সঠিক সংখ্যা তিনি স্মরণ করতে পারেননি।

শিল্পী বীরেন সোম জানালেন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও সাংবাদিকেরাও অনেক সময় বিভিন্ন তথ্য ও পরিকল্পনা দিয়ে আর্ট সেলের শিল্পীদের সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল প্রায়ই আর্ট সেলে আসতেন শিল্পীদের সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য। তাঁর ‘চরমপত্র’ তখন খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। শিল্পীদের তিনি অনেক তথ্য দিতেন। ভেনেজুয়েলার সংবাদপত্রের ওই সংবাদ সম্ভবত তিনিই দিয়েছিলেন। পরে এটি নিয়ে পোস্টকার্ড করা হয়েছিল।

বীরেন সোম জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উদ্দীপনামূলক বক্তব্য অবলম্বন করে পোস্টকার্ড করা হয়েছে। পোস্টকার্ডের ডিজাইনে বেশির ভাগ হস্তাক্ষরই তাঁর বলে স্মৃতিচারণা করলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এ ধরনের মোট ছয়টি পোস্টকার্ড সংগৃহীত আছে। এর মধ্যে চারটি পোস্টকার্ড প্রদর্শন করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া খানের পোস্টকার্ডটি ছাড়া অপর তিনটি একটি হলো ‘জয় বাংলাদেশ, জয় মুক্তিবাহিনী’। কার্ডটি করা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য অবলম্বন করে। অপর দুটি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বক্তব্য অবলম্বনে। এই দুটি পোস্টকার্ডের শিরোনাম ‘পাকিস্তান আজ মৃত’ এবং ‘বিজয় আমাদেরই’।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে থাকা আরও দুটি কার্ডের শিরোনাম ‘আমাদের লক্ষ্য’এবং ‘কেন এই স্বাধীন বাংলাদেশ’। শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য অবলম্বনে এই দুটি পোস্টকার্ড করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে ৮টি মূল পোস্টার রয়েছে। পোস্টারের মধ্যে রয়েছে কামরুল হাসানের করা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’, দেবদাস চক্রবর্তীর করা ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃষ্টান বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালী’, প্রাণেশ মণ্ডলের করা ‘বাংলার মায়ের মেয়েরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা’, নিতুন কুন্ডুর করা ‘সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী’, বীরেন সোম ও নাসির বিশ্বাসের করা ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করুন, এরা আপনাদেরই সন্তান’ এবং ‘বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক ছাত্র যুবক সকলেই আজ মুক্তিযোদ্ধা’, বীরেন সোম ও প্রাণেশ মণ্ডলের করা ‘বাংলাদেশের সম্পদ বৃদ্ধি করুন/ পাকিস্তানী পণ্য বর্জন করুন’ এবং কামরুল হাসান ও নাসির বিশ্বাসের করা ‘একটি বাংলা অক্ষর/ এক একটি বাঙালীর জীবন’।

পরবর্তী সময়ে পোস্টকার্ড ও পোস্টারগুলো হুবহু মূল নকশা অনুসারে পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে। এগুলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নিচতলার বিক্রয়কেন্দ্রে কিনতে পাওয়া যাবে।