প্রজনন মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ‘৬ গুণ’

গত দুই বছরে প্রথম পাঁচ মাসে মৃত্যু না থাকলেও এবার এ সংখ্যা ১৩।

  • জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসকে এডিস মশার প্রজননকাল ধরা হয়।

  • ডেঙ্গু এখন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক রোগ নয়।

  • নতুন ওষুধ বিটিআই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের চিন্তা।

ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশা
ছবি: রয়টার্স

এডিস মশার প্রজননের মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সংখ্যার দিক থেকে গত বছরের প্রথম ‘পাঁচ মাসের’ তুলনায় প্রায় ছয় গুণ। গত বছর এই সময়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যু শূন্য থাকলেও এবার তা ১৩ জন।

সাধারণত জুন থেকে ডেঙ্গুর মৌসুম। কারণ, এই সময়ে বর্ষাকাল শুরু। তখন বৃষ্টির পানি বিভিন্ন স্থানে জমে থাকে। আর এই প্রাদুর্ভাব চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই এই সময়টাকে ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজননকাল ধরে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন
ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এক শিশু
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রজননের মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, এখন এমন অনেক জায়গায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, যেখানে বৃষ্টির পানির সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানি রয়েছে। রাস্তা উঁচু করার ফলে নিচু হয়ে যাওয়া বাসাবাড়ির জমা পানিতেও এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে।

নানান কারণে সারা বছরই এখন পানি জমে থাকছে। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এডিসের আরও বেশি প্রজননক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।
অধ্যাপক কবিরুল বাশার, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২১ মের মধ্যে আক্রান্ত (হাসপাতালে ভর্তি হওয়া) ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল ১০০ জন। এই সময়ের মধ্যে কোনো মৃত্যু ছিল না। পরের বছর ২০২২ সালেও এই সময়ের মধ্যে কোনো ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়নি। তবে আক্রান্ত সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল ২৪৩ জন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ২১ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ১ হাজার ৪৪৭ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি। আর ২০২১ সালের তুলনায়, প্রায় সাড়ে ১৪ গুণ। এ বছর এ পর্যন্ত ১৩ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।

আরও পড়ুন
ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের বাহক এডিস মশা
ছবি: এএফপি

এ ছাড়া ডেঙ্গু এখন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক কোনো রোগ নয়। সারা দেশেই মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ৪০ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন ৪ জন।

বর্তমানে দেশে ১৪৮ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২৬ জন। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ৬, কক্সবাজারে ৩, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, লক্ষ্মীপুরে ২ জন করে এবং কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি ও সাতক্ষীরায় ১ জন করে ভর্তি আছেন। এই ২০ রোগীর বাইরে বাকি ৬ রোগীর মধ্যে ৪ জন ভর্তি রয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ২ জন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

চলতি বছরে ২১ মে পর্যন্ত আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী ১ হাজার ৪৪৭ জন, যা গত বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৯৬ গুণ বেশি। আর ২০২১ সালের তুলনায়, প্রায় সাড়ে ১৪ গুণ। এ বছর এ পর্যন্ত ১৩ ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
এডিস মশার লার্ভা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এডিস মশার প্রজননস্থল রয়েছে এমন ওয়ার্ডে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করা হয় বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক্‌–বর্ষা মৌসুমে চালানো জরিপের প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী এ কর্মসূচি চালানো হয়।

এবার জরিপের ফল অনেক দেরিতে দেওয়ায় সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে গিয়েও লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান ঢাকা দক্ষিণ সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের প্রথম আলোকে বলেন, মশা নিধনের অংশ হিসেবে দক্ষিণ সিটির আওতাধীন ১৩ অংশী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চাওয়া হয়েছে। জুনের মধ্যে মশা নিয়ে নিয়ন্ত্রণকক্ষ চালু করা হবে।

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। এর জন্য স্কাউট ও বিএনসিসির সদস্যদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। জানালেন ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান। নতুন ওষুধ বিটিআই ব্যাকটেরিয়া প্রয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান।

মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, নানান কারণে সারা বছরই এখন পানি জমে থাকছে। মে মাসে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় এডিসের আরও বেশি প্রজননক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সমাধানের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নগরবাসীকে সিটি করপোরেশনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। করপোরেশনের উচিত আক্রান্ত রোগীর এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া।