নির্বাচন সামনে রেখে মানবাধিকার ও নাগরিক পরিসর সংকুচিত হওয়ায় ৬ আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্বেগ

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের ছয়টি সংগঠন বাংলাদেশ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নাগরিক পরিসর সংকুচিত হওয়ার বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের ছয়টি সংগঠন।

 সংগঠনগুলো হলো রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস (আরএফকেএইচআর), ক্যাপিটল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট (সিপিজেপি), দ্য ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট টর্চার কনসোর্টিয়াম (ইউএটিসি), এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেস (এএফএডি), অ্যান্টি-ডেথ পেনাল্টি এশিয়া নেটওয়ার্ক (এডিপিএএন) ও ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেস (আইসিএইডি)। এক যৌথ বিবৃতিতে এই উদ্বেগ জানিয়েছে সংগঠন ছয়টি।

রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের (আরএফকেএইচআর) ওয়েবসাইটে আজ মঙ্গলবার বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে।

 বিবৃতিতে বলা হয়, রাজনৈতিক বিরোধীদের সমন্বিত বিক্ষোভ-সমাবেশের পর গত অক্টোবরের শেষের দিক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমনে সহিংসতার আশ্রয় নিয়েছে।

 এই দমনপীড়নের জেরে একজন সাংবাদিকসহ ১৭ জন নিহত হয়েছেন। প্রায় ৮ হাজার ২৪৯ বিরোধী নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।

 এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে হবিগঞ্জের শায়েস্তানগর এলাকায় আয়োজিত মানববন্ধনের সময় পুলিশ, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছেন।

 বিবৃতিতে বলা হয়, এসব ঘটনা জবাবদিহি এবং যে পরিস্থিতি সহিংসতা-হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটিয়েছে, সেসব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও স্বাধীন তদন্তের প্রয়োজনীয়তার তাগিদ দেয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের নির্বিচারে ও মাত্রাতিরিক্ত কাঁদানে গ্যাসের শেল, লাঠি, রাবার বুলেটসহ অনুরূপ হাতিয়ার ব্যবহারে সহিংসতা বৃদ্ধি গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

 ছয়টি সংগঠন বলেছে, পুলিশের সরঞ্জামের অপব্যবহার মোকাবিলায় অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এই ধরনের হাতিয়ারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহার শুধু নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকেই লঙ্ঘন করে না; তা উত্তেজনা বাড়ায়, এমন পরিবেশ তৈরি করে, যা ভিন্নমত, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও গণতান্ত্রিক সংলাপের ভিত্তিকে দুর্বল করে।

 সংগঠনগুলো বিবৃতিতে বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানদণ্ড অনুসরণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার-সম্পর্কিত জাতিসংঘের মৌলিক নীতি, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কম প্রাণঘাতী অস্ত্রের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার নির্দেশিকা অনুসরণ।

 বিবৃতিতে বলা হয়, উপরন্তু, গত অক্টোবরের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ২০ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে। ব্যাপক ও নির্বিচারে আটক এসব ব্যক্তি বিরোধী দলের সদস্য বলে মনে করা হয়।

ছয়টি সংগঠন বলেছে, বানোয়াট অভিযোগে দায়ের ৮৩৭টি মামলার সঙ্গে এই গ্রেপ্তার–সম্পর্কিত। যেখানে বৈধ কারণ থাকা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জামিন ক্রমাগত নাকচ করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের হেফাজতে নির্যাতন, বেআইনিভাবে নিঃসঙ্গ সেলে রাখার বিষয়ে ধারাবাহিক ও বিশ্বাসযোগ্য খবর রয়েছে।

 বিবৃতিতে বলা হয়, হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের ওপর কথিত নির্যাতন গত মাসের ঘটনার মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ নয়। বরং অতীতেও তা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়। হেফাজতে কথিত নির্যাতনের মধ্যে আছে মারধর, বৈদ্যুতিক শক, ওয়াটারবোর্ডিং, পঙ্গু বানাতে ইচ্ছাকৃতভাবে গুলি করা, হাঁটুভাঙা, মেরে ফেলার উদ্দেশ্যমূলক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা, জোরপূর্বক নগ্ন করা।

 এতে বলা হয়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে প্রধান বিরোধী নেতাদের গণহারে দোষী সাব্যস্ত করতে সরকার পদ্ধতিগতভাবে বিচার বিভাগকে ব্যবহার করছে। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিরোধী প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণার জন্য সন্ধ্যায় বর্ধিত সময়ে বিচার করা হচ্ছে।

 ছয় সংগঠন বলেছে, বড় পরিসরের আটক ও দোষী সাব্যস্তকরণ শুধু মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত অখণ্ডতা, ন্যায়বিচারের অধিকারকেই ক্ষুণ্ন করে না, তা অসংখ্য পরিবারকে দুর্দশার মধ্যেও ফেলে দেয়। কারণ, প্রায় ক্ষেত্রেই আটক ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।

 বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে সহিংসতা ও নির্বিচারে আটকের ব্যাপক ব্যবহার দেশটির গণতন্ত্র-মানবাধিকার পরিস্থিতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। একটি সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই অপব্যবহার সংঘটিত হচ্ছে, যেখানে জনগণ আগামী জানুয়ারিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো সমুন্নত রাখার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকারের সহিংস ও দমনমূলক প্রতিক্রিয়া নাগরিকদের জন্য ভয়, উদ্বেগ ও চরম নিরাপত্তাহীন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে।

এতে বলা হয়, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এই সহিংস দমনপীড়নের ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ২০২৪ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় রাজনৈতিক সহিংসতার ব্যাপক বৃদ্ধি, বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার, হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্বিচারে আটক, কর্তৃপক্ষের অত্যধিক বলপ্রয়োগ, বিক্ষোভ-প্রতিবাদ ব্যাহত করতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া, প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরিবারের সদস্যদের হয়রানি, ভয় দেখানো ও বেআইনিভাবে আটক রাখার অভিযোগে তাঁরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

 বিবৃতিতে বলা হয়, আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো খসড়া উপাত্ত সুরক্ষা আইন। যেখানে ‘জাতীয় নিরাপত্তা বা অপরাধ প্রতিরোধ বা শনাক্তের জন্য যদি প্রয়োজনীয় বলে মনে করা হয়’, সে ক্ষেত্রে নাগরিকদের তথ্যে আইন প্রয়োগকারীদের প্রবেশের জন্য সীমাহীন কর্তৃত্বের সুযোগ রাখা হয়েছে।

 ছয়টি সংগঠন বলেছে, এই ধরনের ক্ষমতার অপব্যবহারের ফলে বিশেষ করে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নজরদারি চলতে পারে। বিষয়টি মানবাধিকার, বিশেষ করে গোপনীয়তার অধিকারের জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। যেসব ক্ষেত্রে তথ্য সংগ্রহ ও প্রবেশের (অ্যাকসেস) প্রয়োজন আছে, সেই ক্ষেত্রগুলো অবশ্যই স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। সময় ও পরিসর সীমিত রাখাসহ একটি স্বাধীন বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সাপেক্ষে কাজটি করা উচিত।

বিবৃতিতে বলা হয়, একটি সুষ্ঠু, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজের জন্য বাংলাদেশের জনগণ সংগ্রাম করছে। তারা (ছয় সংগঠন) বাংলাদেশের জনগণের পাশে আছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশানা করে সহিংসতা, দমনপীড়ন, ভয় দেখানো অবিলম্বে বন্ধের জন্য তারা জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছে। তাই তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এই আহ্বান জানাচ্ছে—

  •  অবিলম্বে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করুন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকার নিশ্চিত করুন। জীবন, স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত অখণ্ডতার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখান। এগুলো সুরক্ষিত করুন।

  •  অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করুন। নির্বিচারে আটক সব কর্মী ও বিরোধী দলের সদস্যকে মুক্তি দিন। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করুন।

  •  ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করুন। বিশেষ করে মৃত্যু ও নির্যাতনের অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে।

  • নাগরিকদের গোপনীয়তা ও অধিকার রক্ষা করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নিশ্চিত করতে উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন করুন।

 উপরন্তু, ছয়টি সংগঠন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও দেশটিতে মৌলিক অধিকার রক্ষার পক্ষে কাজ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।