৪ বছরে কাজ হয়নি অর্ধেকও

প্রকল্পের কাজ শেষ হতেই লাগবে অন্তত দুই বছর। পুরান ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস থেকে শিগগির নিস্তার নেই।

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে বিসিকের উদ্যোগে রাসায়নিক শিল্পপার্কের নির্মাণকাজ চলছে। তবে কাজ চলছে খুব ধীরগতিতে। সাম্প্রতিক ছবি
প্রথম আলো

নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও রাসায়নিক শিল্পপার্কের কাজ অর্ধেকও শেষ হয়নি। বিসিকের উদ্যোগে মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানে প্রায় ৩১০ একর জায়গায় রাসায়নিক শিল্পপার্ক নির্মাণ শেষ করার নির্ধারিত সময় ছিল চলতি বছরের জুন অবধি। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৪৮ ভাগ কাজ হয়েছে। কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালের এপ্রিলে।

এই বর্ধিত মেয়াদে নির্মাণকাজ শেষ হলে প্লট বরাদ্দ শুরু হবে। তারপর সেখানে কারখানা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অর্থাৎ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা স্থানান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হতে আরও বেশ কয়েক বছর লাগবে। মাঝের এই লম্বা সময় রাসায়নিকের কারখানা-গুদামে ভরা ‘মৃত্যুকূপ’ বলে পরিচিত পুরান ঢাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বাস করতে হবে বাসিন্দাদের।

কেরানীগঞ্জ থেকে নবাবগঞ্জ সড়কের তুলসীখালী সেতুর পরেই মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) উদ্যোগে রাসায়নিক শিল্পপার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে। জায়গাটি মূলত মুন্সিগঞ্জের চিত্রকোট ইউনিয়নের আড়িয়াল বিলের প্রান্তবর্তী অংশ। সরেজমিনে দেখা গেছে, সেখানে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। সড়কসংলগ্ন অংশে খানিকটা সীমানাপ্রাচীরও তৈরি করা হয়েছে।

প্রকল্পের বিপরীত পাশেই ভাড়া বাড়িতে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়। প্রকল্প পরিচালক মো.হাফিজুর রহমান জানালেন, মাটি ভরাটের কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। সীমানাপ্রাচীর তৈরির কাজ চলছে, প্রায় ১০ ভাগ কাজ এগিয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ (ডিইডব্লিউ) লিমিটেড মাটি ভরাটের কাজ করছে। সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করছে এমএম বিল্ডার্স নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

প্রকল্প পরিচালক জানালেন, ভূমি উন্নয়ন পর্যায়ের কাজ শেষে হলে পূর্তকাজ, অর্থাৎ ভেতরে সড়ক, অফিস ভবন, প্লট এসব নির্মাণকাজ শুরু হবে। তবে সময় বাড়লেও প্রকল্প বাস্তবায়নের খরচ কমেছে। প্রথম পর্যায়ে ৩১০ একর জায়গায় এই রাসায়নিক শিল্পপার্ক গড়ে তোলার জন্য ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। সেখান থেকে এখন ১৬১ কোটি টাকা কম লাগবে। জমি অধিগ্রহণের জন্য যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার চেয়ে কম দামে জমি কিনতে পারায় খরচ কমেছে।

যা থাকবে

বিসিকের এই রাসায়নিক শিল্পপার্কের কারখানার জন্য প্লট থাকবে প্রায় ১ হাজার ৯০০টি। এ ছাড়া জলপথে মালামাল আনা নেওয়ার জন্য দুটি জেটি থাকবে। এ জন্য প্রায় দেড় কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ করা হবে। এ ছাড়া কঠিন ও তরল বর্জ্যের জন্য পৃথক শোধনাগার, অত্যাধুনিক সুবিধাসংবলিত একটি ফায়ার স্টেশন, নিজস্ব পাওয়ার স্টেশন, গবেষণাকেন্দ্র, ডে-কেয়ার সেন্টার, চিকিৎসাকেন্দ্র, মসজিদ, পুলিশ ফাঁড়ি, শিল্প মালিক সমিতির জন্য কার্যালয় থাকবে। ভেতরের সড়কগুলো হবে ১০ ফুট প্রশস্ত। এর দুই পাশে গাছ লাগানো হবে এবং ভেতরে প্রায় ১০ একর জায়গায় সবুজ বনানী গড়ে তোলা হবে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল পারফিউমারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ মাসুদ জানান, রাসায়নিক শিল্পপার্কের জন্য এখনো তাঁদের কাছে প্লট বরাদ্দের আবেদন চাওয়া হয়নি। অবকাঠামোর কাজ শেষ হওয়ার পর পুরান ঢাকা থেকে কারখানা ও গুদাম সরানোর কাজ শুরু হবে। স্থানান্তরের কাজ পুরো শেষ হতে বেশ লম্বা সময়ই লাগবে। তবে কেমিক্যাল শিল্পপার্ক গড়ে তোলা হলে পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ঝুঁকিমুক্ত হবেন।

নিমতলী-চুড়িহাট্টা বিপর্যয়

বহুকাল থেকে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার, নিমতলী, চকবাজার, চুড়িহাট্টা, আরমানিটোলা, মাজেদ সরদার রোড, রহমতগঞ্জ, হাজী আজগর লেনসহ বিভিন্ন মহল্লায় সংকীর্ণ জায়গার বহুতল ভবনে, এমনকি আবাসিক বাড়ির নিচতলায় গড়ে তোলা হয়েছে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম। সেখানে সবচেয়ে বড় বিপর্যয়কর দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন। রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। সে সময় প্রবল দাবি উঠেছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা ও গুদাম সরিয়ে ফেলার। কিন্তু তারপরও সেই প্রক্রিয়া তেমন এগোয়নি।

এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আবার এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে সুগন্ধি তৈরির কারখানায়। এতে ৭১ জন প্রাণ হারান। আবার পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা স্থানান্তরের দাবি প্রবল হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সেবা সংস্থার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয় এবং পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা উচ্ছেদের অভিযান শুরু করে। চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পুরান ঢাকায় অভিযান শুরু করে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স।

২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিলে ১ হাজার ৬১৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে মুন্সিগঞ্জের এই রাসায়নিক শিল্পপার্ক প্রকল্প একনেকের অনুমোদন পায়। জমি অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয় ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর। এরপর শুরু হয় ভূমি উন্নয়নের কাজ, যা এখনো চলছে।