জীবনের যাত্রাপথের ৯০তম মাইলফলক পার হলেন সন্জীদা খাতুন। কোনো একক অভিধায় তাঁর পরিচয় প্রকাশ দুরূহ। জীবনের এই কালপ্রবাহ তিনি অতিক্রম করেছেন বহু বিচিত্র কর্ম ও সাধনায়। রংধনুর মতো বর্ণময় হয়ে উঠেছে তাঁর নবতিপর জীবন। আলোকিত করেছেন সংস্কৃতির অঙ্গন। এখনো চিন্তাচেতনায় রয়েছেন নতুন।
সন্জীদা খাতুনের কথা উঠলে প্রথমেই তাঁকে দেশের সংস্কৃতি, মনন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সম্মুখ স্থানে সক্রিয় এক অনন্য ব্যক্তি হিসেবেই মনে পড়ে। পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করে অবসর গ্রহণ করেছেন। গবেষণা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিলেও শিক্ষকতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি।
নতুন প্রজন্মের মানবিক বিকাশের জন্য শৈশব থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নালন্দা উচ্চবিদ্যালয়। আর গানের স্কুল ছায়ানট তো আছেই—যা কেবল বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার অগ্রণী প্রতিষ্ঠানই নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে বলে বিদগ্ধজনেরা মনে করেন।
সন্জীদা খাতুনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছিল এক উদার, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবারে। ১৯৩৩ সালের ৪ এপ্রিল তাঁর জন্ম। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন চিন্তা, সৃজন, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তি। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। ১১ ভাইবোন ও আত্মীয়দের যৌথ পরিবার। বাবাকে ঘিরে তৎকালীন প্রণিধানযোগ্য শিল্পী, সাহিত্যিকদের সমাগম ছিল তাঁদের বাড়িতে। সন্জীদা খাতুনের মানস গঠনের উন্মেষ হয়েছিল এখান থেকেই।
পড়ালেখা কামরুন্নেসা স্কুল, ইডেন কলেজ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ১৯৫৪ সালে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী থেকে ১৯৫৫ সালে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর এবং পরে সেখান থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি লাভ। বিভিন্ন সরকারি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করে অবসর গ্রহণ।
সন্জীদা খাতুন শিল্পী ও সংগীতজ্ঞ। গান গেয়েছেন যেমন, গ্রন্থ রচনাও করেছেন তিনি। গবেষণা, সাহিত্য সমালোচনা, সমাজ-সংস্কৃতি, আত্মজীবনী মিলিয়ে বইয়ের সংখ্যা ৪০টির অধিক। পেয়েছেন একুশে পদকসহ বাংলা একাডেমি পুরস্কার। পশ্চিমবঙ্গ থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য ও ভারত সরকারের পদ্মশ্রী হয়ে নিজের সম্মানের পাশাপাশি দেশের গৌরবও বৃদ্ধি করেছেন।
সন্জীদা খাতুন ছাত্রজীবন থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছিলেন সংগীত, কবিতা আবৃত্তি ও অভিনয় শিক্ষায়। সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সঙ্গে ব্যস্ত থেকেছেন সাংগঠনিক কাজে। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
সন্জীদা খাতুন পঞ্চাশ ও ষাট দশকের প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। স্বদেশ ও সমকালের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক থেকেছেন প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসকদের বাধা উপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন এবং তার সূত্র ধরে পরে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট গঠনে অনেকের সঙ্গে সন্জীদা খাতুন ছিলেন নেতৃস্থানে। রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন দেশের সংস্কৃতির পরিচর্যা ও বিকাশের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে।
বিশেষ করে ২০০১ সালে বর্ষবরণের প্রভাতি অনুষ্ঠানে জঙ্গিদের মারাত্মক বোমা হামলা সত্ত্বেও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে এই অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে তিনি সাহসিকতার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কর্মীদের মনে সাহস সঞ্চার ও প্রেরণা জুগিয়ে যাবে।
সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে গত অর্ধশতাব্দীতে ছায়ানট এক অসাধারণ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এই মর্যাদাময় প্রতিষ্ঠান কেবল সংগীত শিক্ষার স্কুল নয়, ছায়ানটকে ঘিরে সুকুমার বৃত্তির বহুমাত্রিক পরিচর্যা সারা দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত আছে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। বাচিক শিল্পচর্চার প্রতিষ্ঠান কণ্ঠশীলনের সংযোগ।
এসব সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এমন বহুবিধ কার্যক্রম আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ ও মানবিক সমাজ গঠনের উদ্যোগকে অগ্রগামী করে চলেছে। জাতীয় পরিচয়কে গৌরবান্বিত করে তুলেছে।
সন্জীদা খাতুন এত সব বৈচিত্র্যময় কাজের ভেতর দিয়ে পেরিয়ে এলেন নব্বই বছর। নিজেকে নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়, আলোকিত করলেন স্বদেশ ও স্বজাতির মুখ। তাঁর মতো মানুষের জন্মের প্রত্যাশাতেই থাকে সব জাতি, সব কালে। শতায়ু হন তিনি।
অনুষ্ঠান: সন্জীদা খাতুনের ৯০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ছায়ানটের আয়োজনে অনুষ্ঠান হবে সকাল ১০টায়, ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে।