ভারতে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আভিন জানলেন জিপিএ–৫ পেয়েছেন তিনি

এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছেন আভিন নূর
ছবি: সংগৃহীত

‘আমি স্কুলে যেতে চাই’ শিরোনামে ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রথম আলোতে লিখেছিলেন আভিন নূর। তবে স্কুল-কলেজে ভর্তি থেকেও আর ১০ জনের মতো প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায় পা রাখার সুযোগ হয়নি তাঁর। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে বা ঘরবন্দী হয়ে কাটাতে হয়েছে বেশির ভাগ সময়। সেই আভিন নূর এবার এইচএসসিতে বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছেন।

আভিন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী। ছোটবেলা থেকে যক্ষ্মাসহ নানা শারীরিক সমস্যার কারণে হাঁটতে পারেন না। আজ রোববার যখন এইচএসসির ফল জানতে পারেন, তখনো হাসপাতালের বিছানায় বন্দী তিনি। ১৩ নভেম্বর থেকে দক্ষিণ ভারতের ভেলোর শহরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের পুনর্বাসন ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন আভিন। সঙ্গে আছেন মা আসমা উল হুসনা।

আভিন ও তাঁর মায়ের সঙ্গে আজ কথা হয় প্রথম আলোর। ভেলোরে তাঁদের হাসপাতালের এলাকায় তখন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। এর জেরে নেটওয়ার্কের সমস্যায় বেশ কয়েকবারে কথা বলা সম্ভব হয়। আসমা উল হুসনা বলেন, ‘মেয়ের স্কুল-কলেজের শিক্ষক–শিক্ষার্থীসহ সবার সহযোগিতায় আমার আভিন এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে। মেয়ের ফলাফলের কথা শুনে খুব ভালো লাগছে। ও যেভাবে সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়ে আসছে, তা অব্যাহত থাকলে মেয়ে হয়তো একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে। জীবনটাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে নিতে পারবে।’

আভিনের চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদে চালিয়ে যেতে হবে বলে জানিয়েছেন ভেলোরের চিকিৎসকেরা। আসমা উল হুসনা বললেন, ‘মেয়েকে নিয়ে আশা–নিরাশার দোলাচলে রয়েছি। কোনো চিকিৎসক সরাসরি জানিয়ে দিতেন আভিনের আর কোনো চিকিৎসা নেই। আবার কোনো চিকিৎসক আশা দিয়েছেন। বর্তমানে বিভিন্ন পরীক্ষায় মেয়ের যক্ষ্মা আর নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তবে তার ডান হাঁটুর হাড় পেছনে দিকে চলে যাওয়ায় চিকিৎসা চলছে। মেয়ের সুস্থ হতে সময় লাগবে। চিকিৎসা কত দিন চালিয়ে নিতে পারব, তা নিয়েই এখন চিন্তা।’

২০১৬ সালের ১১ আগস্ট ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক সঙ্গীতা ইমাম ও কাজী শাহেলা নাজনীন প্রথম আলোতে আভিন নূরের জন্য লিখেছিলেন ‘আবার জ্বলে উঠুক আভিন নূর’ শিরোনাম। সঙ্গীতা ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আভিন যখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত, তখন থেকেই তাকে চিনি। পড়াশোনার জন্য আভিনের মানসিক জোর ও দৃঢ়তা এবং তার মায়ের সংগ্রামের ফলেই এইচএসসিতে আভিন জিপিএ–৫ পেয়েছে।’

আভিন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। তারপরই বিপত্তি ঘটে। পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। এক চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যায়াম করতে গিয়ে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়।

সঙ্গীতা ইমাম বলেন, ‘বলতে গেলে বিছানায় শুয়ে শুয়েই সে আভিন (স্কুল ও কলেজে) এ পর্যন্ত এসেছে। স্কুল বা কলেজে সে কখনোই নিয়মিত আসতে পারেনি। আভিনের মা তিনতলা থেকে মেয়েকে কোলে করে নিচে নামিয়ে কলেজে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নিয়ে আসতেন। নিচতলায় আমাদের মেডিকেল সেন্টারে বসেই পরীক্ষা দিত আভিন। এভাবে এসএসসিতে জিপিএ–৪ দশমিক ৩৬ পেয়েছিল। এরপর কলেজে লিফট চালু হলো। হুইলচেয়ারে করে মাঝে মাঝে কলেজে এসেছে ও।’

সঙ্গীতা ইমাম জানালেন, স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা সব সময় আভিনের পাশে ছিলেন। আর্থিকভাবে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষকসহ অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেছেন। প্রথম আলোতে তাঁর ও শিক্ষক কাজী শাহেলা নাজনীনের লেখার পর মানুষের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। তখন আভিনের চিকিৎসার জন্য প্রায় ৯ লাখ টাকা সহায়তা পাওয়া গিয়েছিল।

প্রথম আলোতে ছোটবেলায় আভিন তাঁর লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ২০১০ সালে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর তাঁর দিনগুলো ভালোই কাটছিল। রোজ মায়ের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা, পরিবারের সবার সঙ্গে আনন্দ—এভাবেই চলছিল। কিন্তু এরই মধ্যে তিন বছর যেতে না-যেতেই হঠাৎ অসুস্থ হতে থাকে তাঁর শরীর। একসময় পুরোপুরি শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে যান তিনি। বন্ধ হয়ে যায় স্কুলে যাওয়া–খেলাধুলা।

তৃতীয় শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় অসুস্থ হওয়া শুরু করেন আভিন
ছবি: সংগৃহীত

সে সময় আভিন প্রথম আলোতে লিখেছিলেন, ‘আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন। আমি যেন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারি।’ আভিনের এ আহ্বান এখনো আছে। কলেজের গণ্ডি পার হওয়া আভিন ঘরবন্দী হয়ে থাকতে চান না। অনিশ্চিত সুতায় ঝুলতে চান না। তিনি চান আবার নতুন করে জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখতে।  

আভিন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। এক চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যায়াম করতে গিয়ে তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। আসলে তত দিনে যক্ষ্মার কারণে আভিনের হাড়ে ক্ষয় হওয়া শুরু হয়েছিল। তাই ব্যায়াম করাটা হিতে বিপরীত হয়। ২০১২ সালে অস্ত্রোপচার করে আভিনের মেরুদণ্ডে চারটি স্ক্রু বসানো হয়। সেই সঙ্গে চলে যক্ষ্মার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। একসময় সাভারের সিআরপিতে বিনা মূল্যে তাঁর চিকিৎসা চলে। একপর্যায়ে পারিবারিক কারণে আভিন তাঁর মায়ের সঙ্গে মামার বাসায় থাকা শুরু করেন। এখনো সেখানেই আছেন তিনি।

আভিনের মা আসমা উল হুসনা বললেন, ‘বিছানায় বসেই মেয়েটা পড়াশোনা করেছে। ওকে কোচিংয়ে ভর্তি করতে পারিনি। বাসায় সেভাবে শিক্ষক দিতে পারিনি।’

হোয়াটসঅ্যাপে আভিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষা ভালোই দিয়েছিলাম। তারপরও জিপিএ–৫ ছুটে যায় কি না, তা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম। ফলাফল জানার পর এখন চিন্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব কি না, তা নিয়ে। শারীরিকভাবে আগের চেয়ে একটু একটু করে ভালো হচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। তাই যে করেই হোক আগে পুরোপুরি সুস্থ হতে চাই। আর পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে চাই। পড়াশোনা শেষ করে একজন উদ্যোক্তা হতে চাই।’

আভিনের মা আসমা উল হুসনা বললেন, ‘মেয়ের চিকিৎসায় কখনো পিছপা হইনি। বিছানায় বসেই মেয়েটা পড়াশোনা করেছে। ওকে কোচিংয়ে ভর্তি করতে পারিনি। বাসায় সেভাবে শিক্ষক দিতে পারিনি। সৃষ্টিকর্তা এবং আমাদের মা ও মেয়ে পাশে যে মানুষগুলো ছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’