দেশের ১৪% নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রা অনুযায়ী সমীক্ষা করলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা আরও বাড়বে।

  • ২০ বছর পর নলকূপের আর্সেনিক নিয়ে সমীক্ষা।

  • ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮০টি নলকূপ পরীক্ষা।

  • লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৮টি নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক।

আর্সেনিকযুক্ত নলকূপে
প্রতীকী ছবি

গত ২০ বছরে দেশে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে। তবে এখনো দেশের ১৪ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে।

দেশের নলকূপে আর্সেনিকের মানমাত্রা নিয়ে করা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক লিটার পানিতে কী পরিমাণ আর্সেনিক থাকলে তা নিরাপদ, সেটি নিয়ে আন্তর্জাতিক মান এবং দেশীয় মানে পার্থক্য রয়েছে। ওই সমীক্ষা সরকার নির্ধারিত মান ধরে করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাত্রা অনুযায়ী করলে আর্সেনিকযুক্ত নলকূপের সংখ্যা আরও বাড়বে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশের নলকূপের আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়েছিল ২০০৩ সালে। তখন দেশের ২৯ শতাংশ নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। এরপর ২০ বছরে কোনো সমীক্ষা হয়নি। ফলে দেশের কত সংখ্যক নলকূপে এখন সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে, সেটি বোঝা যাচ্ছে না।

২০১৯ সালে ‘পানি সরবরাহে আর্সেনিক ঝুঁকি নিরসন’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। পার্বত্য জেলাগুলোসহ ১০টি জেলা ছাড়া বাকি ৫৪ জেলায় কমবেশি আর্সেনিকের প্রকোপ রয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে দেশের ৫৪ জেলার নলকূপের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৩ হাজার ২০০টি ইউনিয়নের নলকূপ পরীক্ষা করা হয়। ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮০টি নলকূপ পরীক্ষা করে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৫৪৮টি নলকূপে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায়, শতাংশের হিসেবে যা ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। 

প্রকল্পের পরিচালক বিধান চন্দ্র দে প্রথম আলোকে বলেন, গত ২০ বছরে আর্সেনিক দূষণের পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে। অগভীর নলকূপের সংখ্যা কমেছে। লোকজন আর্সেনিক বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন।

সমীক্ষায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি গোপালগঞ্জ জেলার ৫২ দশমিক ৫৭ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। চাঁদপুরের ৫১ দশমিক ৩৫, কুমিল্লার ৪৪ দশমিক ৯১, সাতক্ষীরার ৪০ দশমিক ৮৫ এবং লক্ষ্মীপুরের ৩৪ দশমিক ২২ শতাংশ নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। সবচেয়ে কম আর্সেনিকযুক্ত নলকূপ রয়েছে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নওগাঁ, নাটোর, রংপুর ও গাজীপুর জেলায়।

আর্সেনিক মূলত একপ্রকার রাসায়নিক উপাদান। পানিতে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক সব সময়ই থাকে। যখন এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, তখন মানবদেহে নানা রোগের উপসর্গ তৈরি করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৬০ দশকে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিকের সহনীয় মাত্রা নির্ধারণ করে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামে। এরপর ১৯৯৩ সালে তা দশমিক শূন্য ১ মিলিগ্রামে কমিয়ে আনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ১৯৬৩ সালের সেই মাত্রা আর পরিবর্তন করেনি। বাংলাদেশ সরকার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি লিটার পানিতে দশমিক শূন্য ৫ মিলিগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলে সে পানি পান করা কিংবা রান্নার কাজে ব্যবহার করা যাবে না।

যাদের শরীরে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া ধরা পড়ে, তাদের ‘আর্সেনিকোসিসে’ আক্রান্ত রোগী বলা হয়। দেশে আর্সেনিকের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বা তাদের চিকিৎসা–পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ২০১৯ সালের গুচ্ছ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে। সেই হিসাবে প্রায় ২ কোটি মানুষ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ইশতেহারে বলা হয়েছিল, ২০১১ সালের মধ্যে আর্সেনিকের সমস্যা সমাধান করে সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

দেশে আর্সেনিকের পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইডের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান খায়রুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বছরে ১ শতাংশ নলকূপ আর্সেনিকমুক্ত হলে আরও ১৪ বছর লাগবে।

আর্সেনিকমুক্ত করার কার্যক্রমের গতি বাড়াতে হবে। এরপর বৈশ্বিক মান অনুযায়ী একটি সমীক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগ আর্সেনিকে আক্রান্ত রোগীর হিসাব রাখে না। রোগীদের চিহ্নিত করা প্রয়োজন।