গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিতের হাতিয়ার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যসহ (বাঁ থেকে তৃতীয়) বিশিষ্ট আলোচকেরা। ঢাকা, ১১ অক্টোবর
ছবি: আশরাফুল আলম

বর্তমানে বাংলাদেশে দুটি সমাজ সৃষ্টি হয়েছে, একটি পিছিয়ে পড়াদের আর অন্যটি অনেক এগিয়ে যাওয়াদের। ন্যায্যতাভিত্তিক উন্নয়ন না হওয়ায় সমাজে বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। এই সময়ে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি দুর্বল হয়েছে। জবাবদিহি নিশ্চিত করার হাতিয়ার অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন।  

আজ বুধবার রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বিশিষ্ট আলোচকেরা এসব কথা বলেন। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও ন্যায্যতার লক্ষ্যে নাগরিক অ্যাজেন্ডা: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন ও সামাজিক সুরক্ষা’ শীর্ষক এই ব্রিফিংয়ে বিষয়ভিত্তিক চারটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়।


শুরুতেই প্রতিবেদনগুলোর পরিপ্রেক্ষিত ও তাৎপর্য তুলে ধরেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে উন্নয়নের যে আখ্যান শুনি, সেটা কতটা সত্য ও সঠিক তা বোঝা প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে। সাম্প্রতিককালে মধ্যবিত্তের ভূমিকা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। অত্যন্ত বিত্তবান, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত—এই তিন চরিত্র নিয়ে একটি গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে।’

সাম্প্রতিককালে মধ্যবিত্তের ভূমিকা ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। অত্যন্ত বিত্তবান, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত—এই তিন চরিত্র নিয়ে একটি গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বিশেষ ফেলো, সিপিডি

প্রকৃত উন্নয়ন চাইলে পিছিয়ে পড়াদের হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, উন্নয়নের মধ্যে ন্যায্যতা আনতে হবে। গণতান্ত্রিক জবাবদিহি না থাকলে ঘাটতি থেকেই যাবে। নাগরিকদের অধিকার প্রকাশের বড় ক্রীড়াক্ষেত্র হচ্ছে নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও নিয়ম-নীতির মধ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচন এই জবাবদিহি নিশ্চিতের হাতিয়ার।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপের সদস্য ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার সুরক্ষিত থাকে, এমন মানবিক সমাজ গড়তে পেরেছি কি না, সে প্রশ্ন রয়েছে। দেশে অনেক মানুষ আছে, যারা ন্যায়বিচার ও মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত। সবার জন্য একধরনের উন্নয়ন চলে না।  

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপের সদস্য ও সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, দেশের বড় একটা অংশকে বাদ দিয়ে আর্থসামাজিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক শাসনে পিছিয়ে পড়া ব্যক্তিরাও ভোটার। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেগুলোর নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

নাগরিক প্ল্যাটফর্ম গত বছর দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে স্থানীয় নাগরিকদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে। এসব আলোচনা থেকে যে মতামত পাওয়া গেছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে ১১টি বিষয় চিহ্নিত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ দল এসবের ওপর বিষয়ভিত্তিক নীতি–সুপারিশপত্র তৈরি করেছে। এই ব্রিফগুলোতে বর্তমান আর্থসামাজিক চ্যালেঞ্জ, নাগরিকদের প্রত্যাশা এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়ভিত্তিক সুপারিশ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সামাজিক সুরক্ষা—এই চার বিষয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

শিক্ষা আইন কবে হবে

‘মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, উন্নয়নের ছাঁকনি দিয়ে অনেকেই নিচে পড়ে যাচ্ছেন। পিছিয়ে পড়া অনেক শিশু বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। শিক্ষার মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রতিবছর বহু শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাচ্ছেন, তাঁরাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারছেন না।

শিক্ষার বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে যেসব সুপারিশ করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে শিখনঘাটতি দূর করতে বিদ্যালয়ভিত্তিক মূল্যায়ন, উপবৃত্তির অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো, শতভাগ বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল (দুপুরের খাবার) চালু, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ও পাঠ্যবইয়ের মান বাড়ানো। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে শিক্ষানীতি হয়েছে, শিক্ষা আইনের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। কিন্তু এই আইন এখনো হয়নি।

ব্যক্তিগত চিকিৎসা ব্যয় বেশি

‘স্বাস্থ্যব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং ব্যক্তিপর্যায়ে চিকিৎসা ব্যয় হ্রাস’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের উপদেষ্টা ইয়াসমিন এইচ আহমেদ। এতে বলা হয়, স্বাস্থ্য খাতে সুশাসন একটি বড় বিষয়। কমিশন বাণিজ্য ও দালালদের উপস্থিতি চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্থ ব্যয় হয়, তার ৬৭ ভাগই ব্যয় করেন ব্যক্তি নিজে। পাশের দেশগুলোতে ব্যক্তির ব্যয় ৫০ থেকে ৫২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় এই ব্যয় ৩৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে দেশে ৯০ লাখ লোক স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। প্রতিবেদনে ওষুধ আরও সাশ্রয়ী করতে কাঁচামাল দেশে উৎপাদন, স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, দুর্নীতির চক্র ভাঙা, ওষুধ ও পরীক্ষার কমিশন নিয়ন্ত্রণ এবং স্থানীয় পর্যায়ে জবাবদিহি নিশ্চিতের সুপারিশ করা হয়।

প্রকল্পের মূল্যায়ন দরকার

‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট স্থানীয় ঝুঁকি মোকাবিলা করা’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ইশতিয়াক বারী। তাতে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, এখনো দেশের ৪১ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির অভাবে থাকছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের পর দেশে লবণাক্ততার কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এর আওতায় ৮৫১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এসব প্রকল্পের একটি বিশদ মূল্যায়ন সময়ের দাবি। আদৌও এসব প্রকল্প জনগণের কোনো কাজে আসছে কি না, সেটি যাচাই করতে হবে।

সমন্বিত তথ্যভান্ডারের অভাব

‘পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ। তাতে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে। দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর কাছে জাতীয় সম্পদের ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে নিচের সারির ৫ শতাংশের সম্পদ কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে ১১৩ ধরনের সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম চলছে। একই ধরনের একাধিক কর্মসূচি থাকলে সেগুলো একীভূত করার কথা। এত কর্মসূচির মূল্যায়ন দরকার। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য একটি সমন্বিত ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সার্ভিস (এমআইএস) প্রয়োজন। এতে প্রকৃত উপকারভোগী চিহ্নিত করতে সুবিধা হবে।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন

বিষয়ভিত্তিক প্রতিবেদনগুলোতে যেসব সুপারিশ এসেছে সেগুলো বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি বলে আলোচকেরা মনে করেন। তাঁরা বলেন, এই বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলের ইশতেহারে যুক্ত করতে হবে। পর্যাপ্ত অর্থায়ন লাগবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারদের একত্রে কাজ করতে হবে। শক্তিশালী সুশীল সমাজ ও মুক্তমনা আমলাতন্ত্র একসঙ্গে কাজ করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সহজ হবে।