আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারার সেই মামলা বাতিল

হাইকোর্ট ভবনফাইল ছবি

আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ৭ বছর আগে করা মামলা বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে ২০১৮ সালে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলাটি করা হয়। ওই মামলার এফআইআর ও তদন্ত কার্যক্রম বাতিল চেয়ে গত বছরের আগস্টে হাইকোর্টে আবেদন করেন শহিদুল আলম। শুনানি নিয়ে গত বছরের ৪ নভেম্বর হাইকোর্ট রুল দিয়ে মামলার তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রুল যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেওয়া হয়।

আদালতে শহিদুল আলমের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আবদুল্লাহ আল নোমান, কাজী জাহেদ ইকবাল, প্রিয়া আহসান চৌধুরী ও মনিরা হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান। রায় ঘোষণার সময় শহিদুল আলম ও অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

পরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘হাইকোর্ট রায় দিলেন ড. শহিদুল আলমের মামলায়, যেখানে আমরা সাত বছর আগে থেকেই এই যাত্রা শুরু করেছি। ওনার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে মামলা করা হয় তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের সেই ৫৭ ধারার অধীনে, সেটিকে বাতিলের জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। অনেক লম্বা পথ পেরিয়ে অবশেষে আমরা সেই গন্তব্যে পৌঁছেছি। হাইকোর্ট ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় করা মামলাটি বাতিল করেছেন।... মামলাটি চলবে না। খুবই আনন্দিত, অবশেষে এই পর্যায়ে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।’

রায় ঘোষণার পর হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে কথা বলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম ও তাঁর আইনজীবী সারা হোসেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে
ছবি: আইনজীবী আবদুল্লাহ আল নোমানের সৌজন্যে

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘আমরা কিন্তু মামলাটি প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করতে পারতাম। সেই আবেদন ড. শহিদুল আলম করেননি। তিনি মনে করেছেন, আমরা পরামর্শও দিয়েছি, যেহেতু ওনার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মামলাটি হয়েছে, এ বিষয়ে আইনি বিশ্লেষণ আদালত থেকেই পাওয়া উচিত যে এটা কেন অন্যায়। অন্যায় যে মামলা হয়েছে, সেটি যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে শুধু তিনি নন, আরও অনেকেই উপকৃত হবেন। এটি প্রতিষ্ঠিতও হবে যে অন্যায়ভাবে মামলাগুলো করা হতো ও জিইয়েও রাখা হতো। মনে হচ্ছে অতীতে কী কী অন্যায় হয়েছে, সেটি জানতে চাই, বুঝতে চাই। বোঝার জন্য এই মামলা সবচেয়ে ভালো একটা উদাহরণ।’

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট রমনা থানায় মামলাটি হয়। ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির বাসা থেকে শহিদুল আলমকে তুলে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৬ আগস্ট পুলিশ তাঁকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ প্রচারের অভিযোগ তুলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ওই মামলায় শহিদুল আলমকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। মামলায় ১০৭ দিন কারাভোগের পর শহিদুল আলম একই বছরের ২০ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান।

২০১৮ সালের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়। এ অবস্থায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে থাকা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার ওই মামলার তদন্ত কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালের ৩ মার্চ রিট করেন শহিদুল আলম। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট একই বছরের ১৫ মার্চ রুল দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য স্থগিত করেন। ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর হাইকোর্ট শহিদুল আলমের করা রিট খারিজ (রুল ডিসচার্জ) করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন তিনি। এই লিভ টু আপিল খারিজ করে ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর আদেশ দেন আপিল বিভাগ।

এ অবস্থায় এফআইআর ও তদন্ত কার্যক্রম বাতিল চেয়ে গত আগস্টে হাইকোর্টে আবেদন করেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, যার ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে আজ রায় দেন হাইকোর্ট। শহিদুল আলমের আইনজীবীর যুক্তি, ২০১৮ সালের আগস্টে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়। ওই বছরের অক্টোবরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। নতুন আইন অনুসারে আগের আইনের ৫৭ ধারায় করা যেসব মামলার তদন্ত শেষ হয়নি, সাইবার ট্রাইব্যুনালে সূচীত/গৃহীত হয়নি বা বিচারাধীন নয়, সেসব মামলা চলবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের সময় শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে আগের আইনের ৫৭ ধারায় করা মামলাটি তদন্তাধীন ছিল। যে কারণে তদন্ত ও মামলা চলতে পারে না।

‘নাটকের ব্যাপারে গত সরকারের একটা বিশেষ দক্ষতা ছিল’

রায়ের পর আলোকচিত্রী শহিদুল আলম আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, ‘মামলাটি ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নিয়ে। তখন আমি ৪ আগস্ট ছবি তুলছিলাম, লাইভ দিচ্ছিলাম। সেদিন আমাকে আক্রমণ করা হয়, যন্ত্রপাতি ভাঙা হয়। পরদিন আবার গিয়ে লাইভ করি, সেদিন আল-জাজিরায় একটা সাক্ষাৎকার দিই। সেদিন রাতের বেলায় বাড়িতে একা ছবি আপলোড করছিলাম। তখন সিকিউরিটি বাহিনীর অনেকে, কারা তাঁদের চিনি না, আমাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে আমাকে জোরপূর্বক নিয়ে যান। সেই রাতে আমাকে অত্যাচার করা হয়। পরদিন আদালতে হাজির হই। তখন বলি যে আমাকে নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে যেসব জিনিস হওয়ার কথা, নির্যাতনের অভিযোগ এলে তদন্ত করার কথা। কিন্তু সেটি না করে আমাকে রিমান্ডে পাঠানো হয়। তারপর আমি ১০৭ দিন জেলে থাকি। তার মধ্যে পাঁচবার জামিনের আবেদন করা হয়েছিল, সেগুলো নাকচ করা হয়েছিল। ছয়বারের সময় জামিন দেওয়া হয়। তার পর থেকে জামিনে আছি।’

সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো জিনিস ঘটেছে উল্লেখ করে শহিদুল আলম বলেন, ‘এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যে আইনে আমাকে ধরা হয়েছিল, সেই আইন কিন্তু বিলুপ্ত করা হয়েছে ২০১৮ সালে। তারপর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য আইন এসেছে। …আজ সাত বছর পর অবশেষে বিষয়টির নিষ্পত্তি হলো।’

ওই সময়ের ঘটনা উল্লেখ করে শহিদুল আলম বলেন, ‘ডিবি অফিসে আমাকে রাখা হয়েছিল। সে সময় আমি হাঁটছি, সেটি দেখানোর জন্য একটা নাটক দাঁড় করানো হয়েছিল। শুধু সেটি নয়, অনেকগুলো নাটকই তারপরে হয়েছে। নাটকের ব্যাপারে গত সরকারের একটা বিশেষ দক্ষতা ছিল।’

শহিদুল আলম বলেন, ‘আমাদের জন্য যেটি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হচ্ছে আমরা কিন্তু এই আইনকে প্রশ্ন করেছি এবং এভাবে অন্যায়ভাবে আমাকে রাখা হয়েছে, সেটা প্রশ্ন করেছি। শুধু আমার জন্য, সেটা নয়, অনেক ব্যক্তি। এই একইভাবে তাঁদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাঁদের হয়রানি করা হয়েছে এবং সেই সব ব্যক্তি যাঁদের প্রতি এই অন্যায় করা হয়েছে, তাঁদের মুক্তির জন্য আবেদন করছি।’