চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতুতে গাড়ি চলবে আরও এক মাস পর

কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে পথচারী পারাপারের জন্য আলাদাভাবে করা হাঁটার পথ খুলে দেওয়া হয়েছে। গত রোববার সকাল ১০টায় সেতুর চট্টগ্রাম নগর প্রান্তেছবি: জুয়েল শীল

নদী পার হতে ফেরির অপেক্ষায় থাকতে হয় পথচারী ও যাত্রীদের। শুষ্ক মৌসুমে কোনোরকমে চলাচল করা গেলেও বর্ষায় দুর্ভোগ বাড়ে। তখন অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময় ভরা জোয়ারে তলিয়ে যায় ফেরিতে ওঠার বেইলি সেতু। কোমরসমান পানি ডিঙিয়ে যেতে হয় ফেরিতে। কখনো কখনো ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় ফেরি চলাচল। তখন নদী পারাপারে নির্ভর করতে হয় নৌকার ওপর। প্রবল স্রোতের কারণে সে যাত্রা হয়ে ওঠে ঝুঁকিপূর্ণ। ফেরি ও নৌকা করে নদী পার হতে পদে পদে ভোগান্তি। আবার জীবনও ঝুঁকিতে থাকে। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে।

দুর্ভোগের এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদী অংশে। আর যাতায়াত দুর্ভোগের মূলে রয়েছে কালুরঘাট সেতুর সংস্কারকাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়া। সেতুটি যান চলাচলের জন্য উপযোগী করতে অন্তত আরও এক মাসের সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংস্কারকাজের সঙ্গে যুক্ত প্রকৌশলীরা। সেতুর পিচঢালার কাজ (কার্পেটিং) এখনো ২৫ শতাংশ বাকি রয়েছে। এ ছাড়া ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধে সেতুর দুই প্রান্তে উচ্চতা প্রতিবন্ধকতা বসানো হবে। এই কাজ করতে সময় লাগবে। অর্থাৎ নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দাদের যাতায়াত ভোগান্তি দ্রুত দূর হচ্ছে না।

শুরুর দিনই জোয়ারের পানিতে বেইলি সেতু ডুবে যায়। সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল ফেরিও। শুরু থেকে ফেরি পারাপারে যে ভোগান্তি তা আর পুরোপুরি দূর হয়নি। এমনকি দুটি দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

এদিকে হেঁটে পারাপারের জন্য সেতুতে প্রথমবারের মতো নির্মাণ করা ওয়াকওয়ে পবিত্র ঈদুল আজহার আগে খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে যাতায়াত দুর্ভোগ কিছুটা দূর হয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবহারকারী। তবে তাঁরা সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানান।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর ১৯৩১ সালে নির্মিত হয় কালুরঘাট রেলসেতু। ১৯৬২ সালে যান চলাচল শুরু হয়। এর আগে দুবার সংস্কার করা হয়েছিল। কালুরঘাট রেলসেতুর বয়স এখন ৯৩ বছর। ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রেন চলাচলের জন্য সেতুতে বড় ধরনের সংস্কারকাজের উদ্যোগ নেয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল। কাজ শুরু হয় গত বছরের ১ আগস্ট থেকে। এ জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের সঙ্গে ৪৩ কোটি টাকার চুক্তি করে রেল। চুক্তি অনুযায়ী চলতি বছরের মার্চে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।

সেতুর পিচঢালার কাজ (কার্পেটিং) এখনো ২৫ শতাংশ বাকি রয়েছে। এ ছাড়া ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধে সেতুর দুই প্রান্তে উচ্চতা প্রতিবন্ধকতা বসানো হবে। এই কাজ করতে সময় লাগবে। অর্থাৎ নদীর দুই পাড়ের বাসিন্দাদের যাতায়াত ভোগান্তি দ্রুত দূর হচ্ছে না।

সংস্কারকাজ শুরুর দিন থেকে পাশে যাতায়াতের বিকল্প হিসেবে ফেরি চালু করা হয়। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উদ্যোগে ফেরি চালু হয়। তবে শুরুর দিনই জোয়ারের পানিতে বেইলি সেতু ডুবে যায়। সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল ফেরিও। শুরু থেকে ফেরি পারাপারে যে ভোগান্তি তা আর পুরোপুরি দূর হয়নি। এমনকি দুটি দুর্ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

গত শনিবার নৌকা করে নদী পার হওয়ার সময় পানিতে পড়ে মারা যান চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর পরিচালক আশরাফ উদ্দিন। তাঁদের বহনকারী নৌকাটি প্রবল স্রোতে পাশে থেমে থাকা ফেরিতে গিয়ে ধাক্কা মারে। এতে উল্টে পড়ে পানিতে তলিয়ে যান আশরাফ। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল ফেরিতে ওঠার সময় অটোটেম্পোর ধাক্কায় ফাতেমা তুজ জোহরা (১৮) নামের এক কলেজছাত্রী মারা যান।

সংস্কারকাজ দ্রুত সময়ে শেষ করার ব্যাপারে তাঁদের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তহবিল–সংকটের কারণে কাজের গতি কমেছে। বিল ঠিকভাবে পাওয়া গেলে কাজ আরও আগে শেষ করা যেত।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান

কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু দিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এবং পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়ার একটি অংশের মানুষ চট্টগ্রাম নগরে আসা-যাওয়া করে থাকেন। বন্ধ হওয়ার আগে এই সেতু দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো, ছোট পিকআপ, ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), মাইক্রোবাস চলাচল করত। এখন ফেরি দিয়ে পারাপার হয় মানুষ। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ নদী পার হন।

তহবিলসংকটে সংস্কারকাজে দেরি

সেতুর সংস্কারকাজে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ট্রেন চলাচলের বিষয়টি। তাই রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বেশি মনোযোগ দিয়েছিল সেতুটি ট্রেন চলাচলের উপযোগী করতে। গত বছরের ডিসেম্বরে সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। তবে যান চলাচলের উপযোগী করার কাজে গতি ছিল কম।

বন্ধ হওয়ার আগে এই সেতু দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, টেম্পো, ছোট পিকআপ, ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার), মাইক্রোবাস চলাচল করত। এখন ফেরি দিয়ে পারাপার হয় মানুষ। প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার মানুষ নদী পার হন।

নির্ধারিত সময়েও সেতুর সংস্কারকাজ শেষ না হওয়ার জন্য আর্থিক সংকটকে মূল কারণ বলছেন রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা। তাঁদের মতে, রেলওয়ের পক্ষ থেকে সময়মতো সংস্কারকাজের বিল পরিশোধ করা হচ্ছে না। এ কারণে কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকে নির্মাণ উপকরণসামগ্রী আনার ক্ষেত্রেও সময় বেশি লেগেছে।

রেলওয়ের দুই প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সেতুর পিচঢালার কাজ শেষ করতে কিছু সময় লাগবে। এরপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অন্তত আরও এক মাস সময় লাগবে।

রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৭ কোটি টাকার কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু রেলওয়ের পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ২০ কোটি টাকা। এখনো বকেয়া রয়েছে ১৭ কোটি টাকা।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কারকাজ দ্রুত সময়ে শেষ করার ব্যাপারে তাঁদের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু তহবিল–সংকটের কারণে কাজের গতি কমেছে। বিল ঠিকভাবে পাওয়া গেলে কাজ আরও আগে শেষ করা যেত। এখন পর্যন্ত পিচঢালার কাজ হয়েছে ৭৫ শতাংশ। আগামী সপ্তাহে বাকি কাজ শুরু হবে। তা শেষ করতে ১৫ দিন সময় লাগবে। এরপর তা যান চলাচলের উপযোগী হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শক দল।