এক ছটাক জমিও উদ্ধার হয়নি

সংস্থাটির বেদখলে থাকা জমি নিয়ে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আজকের প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান পরিস্থিতি।

  • সারা দেশের সাতটি অঞ্চলে জমি রয়েছে বিজেসির। এর মধ্যে ছয় অঞ্চলের জমিই বেদখল হয়েছে।

  • বিজেসির মোট জমির পরিমাণ ছিল ৬৮৫ একর। ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৯০ একর বিক্রি করা হয়।

সারা দেশের সাতটি অঞ্চলে জমি রয়েছে বিজেসির। এর মধ্যে ছয় অঞ্চলের জমিই বেদখল হয়েছে
ছবি: বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন থেকে নেওয়া

বাংলাদেশ পাট করপোরেশনের (বিজেসি) মোট জমির পরিমাণ ২৯৫ একর। এর মধ্যে ১৯০ একরই বেদখলে। অর্থাৎ করপোরেশনটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ১০৫ একর জমি। এ নিয়ে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর বছর পেরিয়ে গেলেও বেদখল জমির এক ছটাকও উদ্ধার হয়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশের সাতটি অঞ্চলে জমি রয়েছে বিজেসির। এর মধ্যে ছয় অঞ্চলের জমিই বেদখল হয়েছে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ৫৩ একরের মধ্যে প্রায় ২৫ একর, রংপুরে ১৭৫ একরের মধ্যে ১২৯ একর, খুলনার ৩১ একরের মধ্যে ১৯ একর, নারায়ণগঞ্জে ২০ একরের মধ্যে ১৫ একর, নরসিংদীর দশমিক ৪৩ একরের পুরোটাই এবং হবিগঞ্জের ১ একরের মধ্যে পুরোটাই বেদখল হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের ১৩ একরের পুরোটাই বিজেসির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পাট) এবং বিজেসির চেয়ারম্যান তসলিমা কানিজ নাহিদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর জমি উদ্ধারও হয়নি, হারায়ওনি। তা ছাড়া বেদখল জমি উদ্ধারে মামলা চলছে। সারা দেশে জমিজমা রয়েছে, তবে জনবল কম।’

আরও পড়ুন

জমি উদ্ধার নাকি বিক্রি

জানা যায়, বিজেসির মোট জমির পরিমাণ ছিল ৬৮৫ একর। বাংলাদেশ জুট মার্কেটিং করপোরেশন, স্পেশাল প্রপার্টি জুট সেল, জুট ট্রেডিং করপোরেশন, এপিসি র‌্যালি বাংলাদেশ লিমিটেড ও বাংলাদেশ জুট এক্সপোর্ট করপোরেশনকে একীভূত করে সরকার বিজেসি গঠন করে ১৯৮৫ সালের জুলাইয়ে। এর মাত্র ৮ বছরের মাথায় ১৯৯৩ সালে বিজেসিকে বিলুপ্ত করে তৎকালীন সরকার। এরপর ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৯০ একর জমি বিক্রি করে বিজেসি।

তবে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় সম্পত্তি বিক্রি না করে সব সম্পত্তি বার্ষিক ভিত্তিতে ভাড়ার আওতায় আনার নির্দেশনা দেন। অথচ এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে থাকা ১০৫ একর সম্পত্তির মধ্যে ৭০ একরের মতো সম্পত্তি ভাড়ার আওতায় আনতে পেরেছে করপোরেশনটি।

পাটজাত পণ্য
ছবি: বাংলাদেশ পাট করপোরেশনের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

কর্মকর্তারা জানান, সরকার কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে জমি পেতে সমস্যায় পড়েছে। জমি কিনতে গিয়ে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যায়। অনেক সময় জমি পাওয়াও যায় না। মূলত এসব দিক বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী বিজেসির সম্পত্তি বিক্রি না করতে নির্দেশনা দেন। তবে ৫ ফেব্রুয়ারি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিজেসির অবৈধ দখলে থাকা জমি বিক্রি করে টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়ার জন্যই বিজেসি বিলুপ্ত করা হয়েছিল উল্লেখ করে বিজেসির চেয়ারম্যান তসলিমা কানিজ নাহিদা বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত আমরা এখনো পাইনি। তা ছাড়া জমি বিক্রি করতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর নতুন করে নির্দেশনাও লাগবে।’

এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনকে (বিসিক) বিজেসির একটি জমি দেওয়ার জন্য মন্ত্রিপরিষদ থেকে বলা হয়েছে। এরপর বিসিককে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বকেয়া ভাড়া আদায়ে মন্ত্রণালয়ের চিঠি

চেয়ারম্যান ও পরিচালক—এই শীর্ষ দুই কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে বিজেসিতে কর্মরত। ফলে তাঁরা নিয়মিত বিজেসির মতিঝিলের আদমজী কোর্টের প্রধান কার্যালয়ে আসতে পারেন না। সম্পত্তি ভাড়া দেওয়া ও দেখভাল করা ছাড়া অন্য কাজ না থাকায় বিজেসির কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও অলস সময় কাটান।

বিজেসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, করপোরেশনের কার্যক্রম এতটাই স্থবির হয়ে পড়েছে যে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সম্পত্তি ভাড়া দেওয়া হয়েছে, তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ের জন্য দুই বছর চিঠিই দেওয়া হয়নি। ফলে ভাড়া আদায় হয়নি। এ অবস্থায় বকেয়া আদায়ের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ডিসেম্বরে বিজেসিকে চিঠি দেয় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়।

বিজেসির নিয়ন্ত্রণে থাকা সব সম্পত্তি ভাড়ার আওতায় আনতে না পারার বিষয়ে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ভাড়া নবায়ন, নতুনভাবে ভাড়াটে নির্ধারণ, ভাড়া চুক্তির শর্তাদি সংশোধন ইত্যাদি কার্যক্রমের জন্য বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১ অনুসরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে ভাড়াসংক্রান্ত রেজিস্ট্রার বা লেজার গুরুত্বের সঙ্গে হালনাগাদ রাখতে হবে এবং নিয়মিত মনিটরিং (নজরদারি) করতে হবে।

কর্মচারীরা বলেন, এই চিঠির পর বকেয়া ভাড়া আদায়ে গতি বেড়েছে। তবে এখনো সব ভাড়া আদায় করা সম্ভব হয়নি।

ভাড়া দেওয়ার সময় দুই মাসের জামানত নেওয়ার বিধান রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেক ভাড়াটের কাছ থেকে জামানতের টাকা নেওয়া হয়নি।

‘পাট খাতকে ধ্বংস করা হয়েছে’

বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণার সংস্থাটির সম্পত্তি বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও গোটানো কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২৪৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে ‘বিলুপ্ত সেল’ গঠন করা হয়। এরপর তিন দশক হতে চলল, এখনো সংস্থাটির বিলুপ্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। এখনো বিজেসিতে ৮ জন স্থায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অস্থায়ী ভিত্তিতে ৪৮ কর্মচারী কর্মরত। তাঁদের পেছনে সরকারকে অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।

বিজেসির কাজ ছিল সারা দেশের কৃষকদের কাছ থেকে কাঁচা পাট সংগ্রহ করে তা বিদেশে রপ্তানি করা। চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনা থেকে জাহাজে করে পাট চীন, পাকিস্তান, সুদানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেত।

জাতীয় সংসদে বিজেসি বিলুপ্ত ঘোষণার দিন সেখানে উপস্থিত একজন কর্মচারীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় এই প্রতিবেদকের। নাম গোপন রাখার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিজেসি বিলুপ্ত হওয়ার পর সরকারি উদ্যোগে কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর পাট খাতই রসাতলে চলে যায়। বিলুপ্তির ফলে পাট খাত থেকে বিদেশি আয় কমে যায় এবং কৃষকও দাম না পেয়ে উৎপাদন কমিয়ে দেন। ওই কর্মচারী বলেন, ‘তখন বিশ্বব্যাংকের একটা চাপ ছিল বিজেসি বন্ধ করার। কিন্তু সরকার বন্ধ না করলে কিছু হতো না। কোনো সরকার বিজেসির প্রতি সুবিচার করেনি, যার জন্য পাট খাত আর দাঁড়াতে পারেনি। এ খাতকে ধ্বংস করা হয়েছে।’