মুক্তিযুদ্ধের কাছেই আশা তিন প্রজন্মের

নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলছেন চিত্রশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল বার্‌ক্‌ আলভী। পাশে শিল্পী ওয়ারদা আশরাফ। গল্প শুনছে (বাঁ থেকে) শিক্ষার্থী শাকের মাহমুদ সায়েম, মহামায়া খান সঞ্চিতা এবং (ডান থেকে) ফাহাদ রহমান ও গার্গী তনুশ্রী পাল। শুক্রবার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধেতানভীর আহাম্মেদ

২২ মার্চ আমরা যখন ঢাকা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ অঙ্গনে পৌঁছাই, তখন বিকেলের সূর্যরশ্মি সৌধের ত্রিভুজাকৃতি দেয়ালে ঠিকরে পড়ছিল। ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে ৮৪ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিসৌধটির ধোয়ামোছার কাজ প্রায় শেষ। চলছিল আলোকসজ্জার প্রস্তুতি।

স্মৃতিসৌধ সামনে রেখে কিছুটা দূরে লাল চত্বরে এসে দাঁড়ালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী আবুল বার্‌ক্‌ আলভী। সঙ্গে আরও আছেন সংগীতশিল্পী ওয়ারদা আশরাফ। আর এসেছে নতুন প্রজন্মের চার প্রতিনিধি—ভারতেশ্বরী হোমসের দশম শ্রেণির ছাত্রী মহামায়া খান সঞ্চিতা, গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ফাহাদ রহমান, স্কলাস্টিকার নবম শ্রেণির ছাত্রী গার্গী তনুশ্রী পাল এবং গভর্নমেন্ট সায়েন্স হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র শাকের মাহমুদ সায়েম। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রথম আলোর উদ্যোগে আমরা তাঁদের নিয়ে এসেছি স্মৃতিসৌধে।

এই শিক্ষার্থীরা এসেছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প মানে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন-অত্যাচারের কাহিনি। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যাঁরা জীবন উৎসর্গ করলেন, তাঁদের কথা।

চার স্কুলপড়ুয়াই জানাল, এই প্রথম তারা সামনাসামনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দেখছে। কোনো মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।

ফলে তাদের মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি। অন্য রকম ভালো লাগা।

আবুল বার্‌ক্‌ আলভি যখন বিকেলের সূর্যকে পেছনে ফেলে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে বেদিতে বসলেন, চারপাশের পরিবেশ তখন সুনসান। বিদেশি অতিথিদের লাগানো গাছগুলোর সবুজ পাতা দুলছে বাতাসে।

তিনটি ভিন্ন প্রজন্ম। আবুল বার্‌ক্‌ আলভী অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। ওয়ারদা আশরাফ মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিচ্ছেন গানে গানে। শিশুশিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনা।

আবুল বার্‌ক্‌ আলভীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল শিক্ষার্থীরা।

আপনার কাছে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প শুনতে চাই।

স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসলেন আলভী। তিনি বললেন, ‘১৯৬০-এর দশকে চারুকলার ছাত্র থাকতেই আমরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে আমাদের কাজের ক্ষেত্র ছিল মূলত সংস্কৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারি আর পয়লা বৈশাখে আমরা আলপনা আঁকতাম। পয়লা বৈশাখে ছায়ানট গানের আসর করত। সংস্কৃতি সংসদ করত নাটকের আয়োজন।’

মার্চে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের কোনো ঘটনা মনে পড়ে?

মার্চে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রায় প্রতিদিনই অনুষ্ঠান থাকত। সমাবেশ হতো। সেসব অনুষ্ঠানে আমরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিতাম। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কথা স্পষ্ট মনে আছে। আমরা চারুকলা থেকে কয়েকজন মঞ্চের কাছাকাছি বসে তাঁর ভাষণ শুনেছি। সেদিনের ভাষণ যেমন তেজোদীপ্ত ছিল, তেমনি সেটা ছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মূলমন্ত্র। এরপর আন্দোলনটি আর কোনো দলের রইল না, সমগ্র জাতির হয়ে যায়।

২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করল, সে সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি ছিলাম শহীদ মিনার এলাকায়। দেখলাম, পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। ছাত্ররা গাছ ফেলে ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করেছিল। একসময় সেনারা পিলখানার দিকে গেল। এরপরই চারদিক থেকে গুলির শব্দ। আমি তখন আজিমপুরে থাকি। কোনোরকমে বাসায় পৌঁছালাম। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। তখন প্রথমে আমি গেলাম নিউমার্কেটের কাছে চারুকলার হোস্টেলে। দেখি, সব কক্ষ বন্ধ।

আপনি কখন মুক্তিযুদ্ধে গেলেন?

এপ্রিলের মাঝামাঝি। আমি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ত্রিপুরার আগরতলা যাই। তখনো মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো ক্যাম্প হয়নি। পরে মেলাঘরে ক্যাম্প হলো মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। সেটি ছিল ২ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের অধীনে ছিল ক্র্যাক প্লাটুন। আমরা ঠিক করলাম, প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র নিয়ে দেশের ভেতরে ঢুকব। আগস্টের মাঝামাঝি আমি দেশের ভেতরে এসে ঢুকি। গণসংগীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদের বাসা ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উল্টো দিকে। ফতেহ আলী নামের এক বীর মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে অস্ত্র রেখে আসার কথা ছিল। কী মনে করে আলতাফ ভাইয়ের বাসায় অস্ত্রগুলো নিয়ে যাই। রাত হয়ে যাওয়ায় আলতাফ ভাই থেকে যেতে বললেন। আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর হওয়ার আগেই দরজায় প্রচণ্ড ধাক্কা আর বুটের শব্দ। ওরা যেন কীভাবে জেনে গেছে, আমরা অস্ত্র নিয়ে এসেছি। আলতাফ ভাই দরজা খুলে দিলে সেনাসদস্যরা ঢুকেই আমাদের মারতে শুরু করে। লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। এরপর নিয়ে গেল সামরিক আদালতে। এখন যেটি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, আদালত বসানো হয়েছিল সেখানে। তখন সেটি ছিল প্রাদেশিক পরিষদ ভবন।

বিচারে আপনার কী শাস্তি হয়েছিল?

সেনা কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমাদের প্রচণ্ড মারধর করল। জিজ্ঞেস করল, আলভী কে? আমি বুঝে ফেললাম, আমার আগে কেউ ধরা পড়েছিলেন এবং ওদের কাছে আমার নাম বলেছেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, কিছু স্বীকার করব না। বললাম, আমি কখনো সীমান্তে যাইনি। আলভী নামে কাউকে চিনি না। এরপর ওরা আমাকে মারতে মারতে দুই হাতসহ পুরো শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে। একপর্যায়ে আমি অচেতন হয়ে যাই। পরে কী ভেবে ওরা আমাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু আলতাফ মাহমুদকে হত্যা করে।

ছাড়া পাওয়ার পর আপনি কী করলেন?

পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনে আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কিছুটা সুস্থ হলে আবার আগরতলায় ফিরে যাই, নৌকায় করে। আমার হেঁটে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। ফিরে গিয়ে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে দু–একটি অপারেশনেও যাই। একটি অপারেশনে তিনি ফ্রন্টলাইনের পেছনে হাঁটছিলেন। হঠাৎ করে উল্টো দিক থেকে একটি গুলি এসে তাঁর ব্যাটম্যানের গায়ে লাগে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। আমার চোখের সামনেই। পরে আরেকটি অপারেশনে খালেদের মাথায় গুলি লাগে। তবে তিনিও বেঁচে যান।

যুদ্ধের ময়দানে সহযোগী মারা গেলে আপনি ভয় পাননি?

আমরা তো দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়েছি। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য তখন স্বাধীনতা। স্বাধীনতার জন্য প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাই জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন।

স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে এসে কী করলেন?

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে আমি আগরতলা থেকে কলকাতায় যাই। সেখান থেকে ঢাকায় আসি ডিসেম্বরের শেষ দিকে। এসে প্রথমে পুরোনো কর্মস্থল ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশনস অফিসে যোগ দিই। বাহাত্তরে সেখান থেকে চারুকলা কলেজে আসি শিক্ষক হিসেবে, এখন যেটি চারুকলা ইনস্টিটিউট।

এই কিশোর-কিশোরীরা এবার ফিরল ওয়ারদা আশরাফের কাছে। প্রশ্ন করল, আপনি মুক্তিযুদ্ধের গান গাইতে এলেন কেন?

ওয়ারদা আশরাফ বললেন, ‘আমাদের প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু ছোটবেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের গান শুনে, কবিতা পড়ে, নাটক দেখে মুক্তিযুদ্ধ জেনেছি। আমার মনে হলো, আমরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছি, আমাদের পরের প্রজন্মকেও তো সেভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানানো দরকার। এটা ভেবে মুক্তিযুদ্ধ আর দেশের গান গাইতে থাকি।’

এ কথা বলতে বলতে গিটার হাতে ওয়ারদা গাইতে শুরু করলেন, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা।/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক—সকল দেশের সেরা;—/ ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে-দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা;/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ ও সে সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’

তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন আবুল বার্‌ক্‌ আলভী আর শিক্ষার্থীরাও।

এরপর এল জোয়ান বায়েজের বিখ্যাত ‘বাংলাদেশ...বাংলাদেশ’ গানের প্রসঙ্গ। একজন জিজ্ঞেস করল, আপনি জোয়ান বায়েজের মুক্তিযুদ্ধের গানে কীভাবে আগ্রহী হলেন?

ওয়ারদা বললেন, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসন নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে যে কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন, সেটি দারুণ সাড়া ফেলেছিল। এই কনসার্টের মধ্য দিয়ে বিদেশিরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারেন। ২০০৯ সালে বিবিসি রেডিওর মাধ্যমে আমি কনসার্ট সম্পর্কে জানতে পারি। জোয়ান বায়েজ অবশ্য সেই কনসার্টে এই গান গাননি। গেয়েছিলেন আলাদাভাবে। এসব গল্প জানতে জানতে গানটি গাইতে অনুপ্রাণিত বোধ করি।’ গানটির কথা এ রকম: ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ/ অস্তাচলে যেখানে দিন শেষ/ লাখো প্রাণের রক্তে রাঙা দেশ/ নতুন ইতিহাসে/ পুরোনো সেই গল্প ফিরে আসে/ অন্ধ যারা তাদের হাতে ভার/ দেশের সব বিধান বাঁচাবার/ মারছে তাই মানুষ বেশুমার/ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ...রক্তে রাঙা দেশ’ (অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ)

এই গানে একটি জনগোষ্ঠীর আবেগ-অনুভূতি, সংগ্রাম ও বেদনার কথা উঠে এসেছে। এই গানে আছে লাখো প্রাণের রক্তে রাঙা দেশের কথা। কিশোরী মায়ের কোলে শিশুর মারা যাওয়ার কথা। আছে ছাত্রাবাসে পাকিস্তানি সেনাদের ত্রাসের কথা। আছে তরুণদের আত্মাহুতি দেওয়ার কথা। ভাবতে অবাক লাগে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একজন বিদেশি গীতিকার কীভাবে এই অসাধারণ গান লিখলেন।

কথা আর গান শেষ করে আমরা ফিরে আসছি। পশ্চিম আকাশে সূর্য ডোবার আয়োজন চলছে। কিছুক্ষণ পরই নামবে সন্ধ্যা। কিন্তু নতুন প্রজন্মের চার পড়ুয়ার চোখে-মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা শুনে তারা খুবই আনন্দিত। এভাবে যদি সারা দেশের শিশু-কিশোরদেরই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা শোনানো যেত!

ফেরার পথে আবুল বার্‌ক্‌ আলভীর কাছে জানতে চাই, যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আপনারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন, তার কতটুকু পূরণ হলো। তিনি বললেন, ‘অর্জন তো আছে। তবে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, একদিন তা সফল হবেই। সেই আশা নিয়ে বেঁচে আছি।’